বস্তুত গণতন্ত্র নিয়ে বহুরকম সংজ্ঞা শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের পুরনো। ঔপনিবেশিক আমলে আমরা শুনেছি এখানকার মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়, সেজন্য তাদের নিজ রাষ্ট্রেও যে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা আছে তা এখানে প্রবর্তন করা হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বিভিন্ন সরকারের সময়ে ‘মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়’ এরকম কথা বহুবার শুনতে হয়েছে।
পাকিস্তানের জেনারেল আইয়ুব খানের দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে, যখন হার্ভার্ডের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন পথ ঠিক করা হচ্ছিল, তখন ‘এই উন্নয়নের স্বার্থে’ এদেশের মানুষের জন্য ‘উপযোগী’ গণতন্ত্র বানিয়ে ‘উপহার’ দেয়া হয়। নাম তার বেসিক ডেমোক্রেসি (বিডি) বা ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’। এর অর্থ হল দেশের নাগরিকরা সরাসরি ভোটাধিকার পাবে না, তাকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যান নির্বাচনের অধিকার দেয়া হবে। সেই বিডি মেম্বারদের ভোটে নির্বাচিত হবেন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এর পাশাপাশি গ্রামে উন্নয়ন কর্মসূচির নামে, তদারকি বা হিসাব-নিকাশের শৈথিল্য রেখে, বিডি মেম্বারদের জন্য যথাসম্ভব অর্থ বরাদ্দ দেয়া হল এমনভাবে যাকে ঘুষ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বলা হল, ‘উন্নয়নের জন্যই এরকম গণতন্ত্র দরকার। সার্বজনীন ভোটাধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। এগুলো পশ্চিমা মডেল, আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।’
আইয়ুব খানের নেতৃত্বে জেনারেল ও বাইশ পরিবারের এ খেলা জনগণ গ্রহণ করেনি, কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রামাঞ্চলে বিডি মেম্বার আর কেন্দ্রে আইয়ুব খান প্রবল গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে ভেসে যায়। মহা আড়ম্বরে পাকিস্তানজুড়ে ‘উন্নয়নের এক দশক’ পালনের কিছুদিনের মধ্যেই আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতে হয়। আবার সামরিক শাসন। জনমতের চাপে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়; কিন্তু শাসকরাই যে গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয় তা আবারও প্রমাণিত হয়। ভয়ংকর গণহত্যা দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণতন্ত্র ঠেকাতে চেষ্টা করে। পরিণতিতে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
স্বাধীনতার পর দেশকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের ধারা থেকে বের করার সুবর্ণ সম্ভাবনাকে পদদলিত করে কিছু দিনের মধ্যেই আবারও স্বৈরাচারী শাসন বলবৎ হয়। জরুরি অবস্থা জারি ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্রের অবসান ঘটে। এর পর ১৫ বছরের সামরিক শাসনের সময় কখনও নিয়ন্ত্রিত, কখনও ঘরোয়া গণতন্ত্রের খেলা দেখেছি আমরা। দেড় দশকের সামরিক শাসনের পর যে নির্বাচিত সরকারের কাল চলছে তাতে তফাৎ হয়েছে সামান্যই। এরশাদের পদাংক অনুসরণ করে নির্বাচিত সরকারগুলো নিজেদের পকেটের প্রতিষ্ঠান সাজিয়েছে আর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আকাঙ্ক্ষায় একবার খালেদা ও একবার হাসিনার আমলে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনকে পুরোপুরি প্রহসন বানিয়ে এখন যে পরিবারতান্ত্রিক শাসন চলছে তাকে বৈধতা দেয়ার জন্য আবার তোলা হয়েছে সেই পুরনো সুর : ‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ছাড় দিতে হবে’। কিংবা ‘বাংলাদেশ এখনও গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়’।
কী উন্নয়নের চেষ্টা সরকারের, যার জন্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে হবে? সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লোকজন জমি, খালবিল, নদী, পাহাড় দখল করতে চায়? দশ টাকার কাজ একশ’ টাকা দেখিয়ে বাকি টাকা মেরে দিতে চায়? সেজন্যই সব বড় বড় প্রকল্প হাজির হয়, আর দিনে দিনে শুধু তার খরচ বাড়ে? যা তৈরি হয় টাকা মেরে দেয়ার উন্মাদনায় তার সবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, টাকার সৌধ তৈরি হয় অন্য দেশে? ক্ষমতা এবং যোগাযোগের জোরে যারা জনগণের সম্পদ পেটে ভরতে চায় তাদের জন্য জোরজবরদস্তির ব্যবস্থাই দরকার, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা থাকলে সত্যিই অসুবিধা!
একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার ঘটে চলেছে একের পর এক, অন্যদিকে টাকার অভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সড়ক ও রেলওয়ে ধুঁকছে। জাতীয় সংস্থাকে পঙ্গু বানিয়ে, কোণঠাসা করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত দখল বিস্তারে দেশী-বিদেশী কোম্পানিকে ব্ল্যাংক চেক দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত টানা হয়। সেসব দেশে কি জাতীয় সংস্থাকে ডুবিয়ে কমিশনের লোভে বিদেশী কোম্পানির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেয়া হয়েছে? এসব দেশে কি ভিআইপি হলে যা খুশি তাই করা সম্ভব? এসব দেশে কি আইন, বিচারের চেয়ে মন্ত্রীর কথা বড়? এসব দেশে কি প্রতিষ্ঠানের বদলে জমিদারি স্বেচ্ছাচারিতা চলে? সেসব দেশে কি নদী-নালা, খালবিল এবং পাহাড় সবই দখলের বিষয়? সেখানে কি কতিপয়ের লোভ মেটানোর জন্য সুন্দরবনের মতো অনবায়নযোগ্য অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে?
জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি আইন দিয়ে সব অনিয়ম-দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে, আইসিটি আইন দিয়ে সবার চিন্তা-মত বন্ধ করার জন্য ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবাদপত্র টিভি চ্যানেল শুধু নয়, ফেসবুকও এখন চাপের মুখে। যেন মতপ্রকাশ করতে না দিলে সেই মত সমাজ থেকে উবে যাবে! ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্য একের পর এক আটক হচ্ছে, কোনো কিছু না করেও আটক, গুম, খুন হচ্ছে তরুণ-যুবকরা। গ্রেফতার, আটক, ক্রসফায়ার এখন শুধু নিপীড়নের নাম নয়, বাণিজ্যেরও বিষয়। আসলে আইন লাগেও না, দেখাই যাচ্ছে ক্ষমতা আর অর্থ থাকলে যা খুশি তাই করা সম্ভব। আইন নিজের গতিতে চলে না, তা চলে ক্ষমতাবানদের ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুযায়ী। বিভিন্ন বাহিনী ‘হাডুডু খেলার’ বদলে একের পর এক ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ মারছে। অন্যদিকে ত্বকীর খুনিসহ অনেক খুনির রক্ষায় নিয়োজিত আছে প্রশাসন। পহেলা বৈশাখের যৌন সন্ত্রাসের কোনো বিচার হয়নি, পথে-ঘরে-ঘাটে-বাজারে প্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর যৌন সন্ত্রাস চলছেই। পাহাড়ে-সমতলে সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষদের ওপর হামলা-মামলা, জমি সম্পত্তি দখলে কোনো বিরতি নেই। খুনি লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আটক, ক্রসফায়ারের হুমকি। পেটানোর জন্য প্রতিপক্ষ না পেয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ গ্রাম-শহরে শিশু-কিশোর নারী-পুরুষ নানাজনকে মারছে, জমি-টাকা-প্রতিষ্ঠান দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করছে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হল, খুন আর সহিংসতার পক্ষে সমাজে নানাপক্ষ তৈরি করছে সম্মতি। কাউকে সন্ত্রাসী বললে ক্রসফায়ার, কাউকে চোর বললে নৃশংস নির্যাতন, কাউকে নাস্তিক বললে কুপিয়ে হত্যা এসব কিছুর পক্ষে নানা যুক্তি সমাজে তৈরি করা হচ্ছে। অপরাধের জন্য আইন, বিচার, কথার উত্তর কথা, লেখার উত্তর লেখা এতটুকু সহিষ্ণুতা আশা করাই যেন দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গত ৪৩ বছরে জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, বিপুল বিত্তশালী তৈরি হয়েছে, ভবনসহ সড়ক-গাড়ি-বাড়ি বেড়েছে অনেক। কিন্তু মানুষের ন্যূনতম অধিকার, গণতন্ত্র এখনও দুরস্ত! গণতন্ত্র মানে যেমন শুধু ভোট দেয়ার অধিকার বোঝায় না, উন্নয়ন বলতেও তেমনি শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বোঝায় না। কিন্তু গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত সার্বজনীন ভোটাধিকারই এখন এত বছর পর আক্রমণের সম্মুখীন। নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা- তা কখনোই শক্ত ভিত পায়নি। ফলে শাসক পরিবার বা গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতাই এ দেশ পরিচালনার মূল ধরন হিসেবে থেকেছে। সংসদ আছে, নির্বাচন আছে, আইন ও বিচার বিভাগ আছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, তথ্য অধিকার কমিশন আছে। কিন্তু সবই খেলা খেলা।
বাংলাদেশে সরকারি আধা-সরকারি এমনকি বেসরকারি বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য এখন লাখ লাখ টাকা ঘুষ জোগাড়ে নামতে হয় মানুষকে। যোগ্যতা প্রমাণে অর্থ চাই, যোগাযোগ চাই। কোটা আর অঞ্চল দিয়ে যোগ্য তরুণদের সামনে তৈরি করা হয়েছে প্রবল প্রাচীর। অদক্ষ, অযোগ্য, চাটুকার, সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে সব প্রতিষ্ঠান। জাতীয় প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সক্ষমতা, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, প্রশাসন সব এভাবে ডুবিয়ে দিয়ে দেশকে কী উন্নয়নের পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সরকার? বস্তুত ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনা তৈরি হয় লুণ্ঠন, দুর্নীতি আর সর্বজনের সম্পদ দখলকে চিরস্থায়ী করার জন্য। আর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গেলে কোনো সংজ্ঞাতেই গণতন্ত্র রাখা চলে না। এমনকি দলের ভেতরও নয়। বর্তমানে ‘উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র’ যে আওয়াজ তোলা হয়েছে তার সারকথা হল এই যে, কিছু দেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিতে গেলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বন্দি করে ফেলতে হবে। কেননা জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতা রাখলে কতিপয়ের দস্যুবৃত্তি অব্যাহত রাখা যায় না।
(০৯ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখে দৈনিক যুগান্তর এ প্রকাশিত)