গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে গত সরকারের নতুন মেয়াদ শুরু হয়েছে। গত আমলে এই সরকারের যেসব উদ্যোগ দেশকে আরও ঋণগ্রস্ত করেছে, সুন্দরবন থেকে বঙ্গোপসাগরকে হুমকির মুখে নিেক্ষপ করেছে, বিদ্যুৎ খাতকে কতিপয় দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর হাতে আরও বেশি করে আটকে দিয়েছে, তাদের মুনাফা নিশ্চিত করতে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কয়েক দফা, দায়মুক্তি দিয়ে জ্বালানি খাতকে বানানো হয়েছে ‘তলাহীন ঝুড়ি’; সেসব কাজে এই মেয়াদে আরও দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এই সরকার। প্রতিবাদ, যুক্তি, তথ্য—কোনো কিছুতেই তাদের পরোয়া নেই, পর্যালোচনা করার সাহস বা ইচ্ছা নেই। সরকারের বড় সুবিধা, দেশের বড় বিরোধী দল এসব চুক্তির বিরোধী নয়, বরং নিজেরা পাল্লা দিয়ে আরও চুক্তি করতে আগ্রহী। অপকর্মে তাদের ঐক্যের অভাব নেই।
সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়নের নামে একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যেভাবে চুক্তি করে সর্বজনের সম্পদ (পাবলিক প্রপার্টি) বিদেশি কোম্পানি ও দেশি কিছু গোষ্ঠীর ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দিচ্ছে, তাকে কি উন্নয়ন বলা যায়? না। কেননা, উন্নয়ন তাকেই বলা যায়, যা সম্পদ সৃষ্টি করে, নতুন সম্পদ যোগ করে, দেশের মানুষের জীবন সহজ করে, উৎপাদনশীল খাতের সম্প্রসারণে সহায়ক হয়, দেশের সক্ষমতা বাড়ায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জগৎ। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত বরং এর উল্টোটাই করছে।
নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস্য মাত্রায় নির্লিপ্ততা দেখিয়ে, পরিবেশ সমীক্ষা না করে, অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা না করে, দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত থোড়াই কেয়ার করে, নিজস্ব সক্ষমতা না বাড়িয়ে, রাশিয়ার কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে কয়েক দফা চুক্তি করেছে সরকার। পরিবেশগত সমীক্ষা না করে চীনা কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মহেশখালী। সুন্দরবন ধ্বংসের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো ভারতীয় কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজে একগুঁয়েমি দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, সুন্দরবনের আরও কাছে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের অরিয়ন কোম্পানিকে অনুমতি দিয়েছে।
পিএসসি ২০১২ সংশোধন করে চাহিদামতো আরও সুবিধা বাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চুক্তি শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে বাড়তি সুবিধা দিয়ে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। এখন আরও সুবিধা আদায়ের সম্ভাবনা দেখে মার্কিনসহ সব বিদেশি কোম্পানি তড়িঘড়ি নানা ব্যবস্থার লম্বা ফর্দ নিয়ে হাজির হয়েছে। এগুলো নিয়ে দর-কষাকষি তাদের তেমন করতে হয় না। অন্য পক্ষে নিজেদেরই বিশ্বস্ত লোক থাকলে তাদের চিন্তা কী?
৮ মে শেভরনের প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নয় সদস্যের একটি দল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করে। এর মধ্যে যেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, তাদের কাছ থেকে কেনা গ্যাসের দাম আরও বৃদ্ধি করা। উল্লেখ করা দরকার যে বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থাগুলো যে দামে গ্যাস সরবরাহ করে লাভ করছে, বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে একই পরিমাণ গ্যাস কিনতে হয় তার ১০ গুণেরও বেশি দামে, বৈদেশিক মুদ্রায়। অর্থাৎ যদি জাতীয় সংস্থাগুলোকে কাজের সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ অনেক কম দামে পাওয়া সম্ভব হতো, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ত না, ভর্তুকি দিতে হতো না। সর্বোপরি বিদেশি কোম্পানির হাতে জিম্মি হতো না দেশ, যে সুযোগে তারা কদিন পরপরই নতুন নতুন আবদার নিয়ে হাজির হয়। সে কারণেই তারা স্থলভাগে আরও ব্লক দেওয়ার দাবি উত্থাপন করতে পারছে। এ রকম আত্মঘাতী পথে সরকার যাচ্ছে এমন এক সময়, যখন বাপেক্স তার সম্পদের হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আন্তর্জাতিক মান প্রদর্শন করেছে, ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করেছে সফলভাবে। শেভরন এখন তাকে ভাড়া করে কাজ করাতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। মানে বাংলাদেশের তরুণ বিশেষজ্ঞরা অনেক কম সুবিধা পেয়েও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করলেও তাঁরা কর্তৃত্ব পাবেন না, তাঁদের বড়জোর সাবকন্ট্রাক্টর পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে।
শেভরন বর্তমানে বাংলাদেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ সরবরাহ করে। যে ব্লকগুলো এই কোম্পানির হাতে, তার মধ্যে তিনটি গ্যাসফিল্ডে তারা কাজ করছে। এগুলো হলো মৌলভীবাজার, বিবিয়ানা ও জালালাবাদ। সামগ্রিক পরিপ্রেিক্ষত ও বিভিন্ন সরকারের ভূমিকা না জানলে এটা মনেই হতে পারে যে বাংলাদেশের অক্ষমতা থাকার কারণে শেভরন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের জন্যই আজ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো। শেভরনের মতো বিদেশি কোম্পানিকে জায়গা দেওয়ার জন্যই বরং জাতীয় সংস্থার গলা-হাত-পায়ে ফাঁস পরানো হয়েছে, তার কর্মক্ষমতা শৃঙ্খল করা হয়েছে, কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং অনেক বেশি সম্পদ ও সুযোগ দিয়ে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্যাস ব্লকগুলো। আগে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদও এর অন্তর্ভুক্ত।
এসব চুক্তি করা হয়েছিল প্রধানত দুটো যুক্তি দেখিয়ে: বাংলাদেশে ‘পুঁজির অভাব’ এবং ‘দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব’। যে পরিমাণ পুঁজি হলে জাতীয় সংস্থা এই গ্যাস উত্তোলন করতে পারত, পরে তার ৩০ গুণ বেশি খরচ করে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনতে হয়েছে, হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আর পুঁজির অভাবের
( মে ২১, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)