কার শ্রমে কার সমৃদ্ধি?

বাজেটের আকার এবং বরাদ্দ বৃদ্ধি অস্বাভাবিক কিছু নয়। জিডিপি বাড়ছে, অর্থনীতির আকার বাড়ছে। সুতরাং বাজেটও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। বাজেটের আয় তৈরি হয় প্রধানত জনগণের অর্থ দিয়ে। ঘাটতি তৈরি হলে সেটা মোটানো হয় দেশি-বিদেশি ঋণ দিয়ে। জনগণের কাছ থেকে অর্থ নেয়া হয় কর এবং শুল্ক হিসেবে।

বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয় তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর শুল্ক ও ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয়? সেটি হল, সরকারি প্রশাসন- প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। সরকারি আধাসরকারি প্রতিটি গাড়ি, প্রতিটি ভবন, এসি, সভা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, বিলাস, অপচয়, জীবনযাপন, বিদেশ সফর, কেনাকাটা অতএব জনগণের অর্থেই পরিচালিত হয়। জনগণ হয়তো খেয়াল করেন না যে, তাদের ঘরের ওপর বুলডোজার, তাদের মাথায় পুলিশ বা র‌্যাবের লাঠি, তাদের সামনে মন্ত্রী এমপি আমলার চোটপাট কিংবা শানশওকত, নতুন নতুন ভবন, দামী গাড়ি সবই তাদের অর্থেই হয়। সরকার প্রতিশ্রুতি আর টাকা দিয়ে সবাইকে কৃতার্থ করেন। অথচ ঐ টাকা তো সরকারের কারও ব্যক্তিগত নয়, তা মানুষেরই।

জনগণের কাছ থেকে কর শুল্ক সারচার্জ বা বর্ধিত দাম আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের সাধারণত কোনো ব্যর্থতা দেখা যায় না। সরকার জনগণের কাছ থেকে যা চেয়েছে তা দিতে তারা কখনও আপত্তি করেনি। কিন্তু জনগণের পাওনা পরিশোধ করেনি কোনো সরকারই। বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর শুল্ক দেয় তা গত ৪ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-৯ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড – এর আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য রাজস্ব মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা এবং ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কর রাজস্ব ২০ হাজার কোটি টাকাসহ অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিলো ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এবছরের মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৯২ হাজার টাকা। বাকি টাকাও নিশ্চয়ই আদায় হবে। এবছর ২৩ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা বাড়তি কর যোগ হচ্ছে, আর মোট রাজস্ব আয় বাড়ছে ২৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা।

তবে জনগণের বোঝা শুধু বাড়তি কর আর শুল্ক দিয়েই শেষ হয়নি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভুল নীতি, ক্ষতিকর চুক্তি ও দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তার চাপ কমাতে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ঘটনা ২০১২ সাল জুড়েই ঘটেছে। বরাবরের মতো এগুলো সবসময়ই বাজেট ঘোষণার বাইরে। বাড়তি কর শুল্কের চাইতেও গ্যাস ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়কে বাড়িয়েছে অনেক বেশি। শিল্পকৃষি সহ সকল উৎপাদনশীল খাতে উৎপাদন ও পরিবহণ ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদাংশ তারা কিন্তু এখনও করজালের বাইরে। সরকারের সমীক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিশাল অংশের অর্থ সরকারের হিসাবে নাই। টাকার অংকে এটা হবে প্রায় ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা। এই আয়ের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপ্রদর্শিত আয়’, অর্থশাস্ত্রে বা সাধারণ পরিচয়ে এর আরেকটি নাম, ‘কালো টাকা’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, বিভিন্ন কারণে কর না দেওয়ার কারণে তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, এই টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’ যা চুরি, ডাকাতি, লুন্ঠন, ক্ষমতা প্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজন সম্পদ আতœসাৎ, উর্দিপরা ও উর্দিছাড়াদের চাঁদাবাজি, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। সবাই জানেন, এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয় প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না। তাই সব সরকারের আমলেই আমরা ‘কালো টাকা’ সাদা করার নানাকথা শুনি, কিন্তু এর উৎস বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কারণ চোরাই টাকার মালিক আর সরকারি প্রশাসন বস্তুত একাকার।

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের হিসাবে না থাকলেও তার বিরাট অংশের টাকা যেভাবে উপার্জিত হয়, তাতে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, আর সন্ত্রাসী বাহিনীর পুনরুৎপাদনই স্বাভাবিক। এই বিশাল সম্পদ ও অর্থ করদানের আওতার বাইরে এবং তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান। গত কয়েক দশকে যে উন্নয়ন গতিধারা সরকার নির্বিশেষে পুষ্ট হচ্ছে – এটা তারই ফল। অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে যখন বলেন, ‘এই উন্নয়ন গতিধারা অব্যাহত থাকবে’, তখন তাই আমরা আতংকিত হই। বুঝি সামনের বছর বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, প্রকল্প-অপ্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে দিয়ে চোরাই টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।

রাজস্ব আয়ের এই সম্ভাব্য বিশাল উৎস শুধু যে সরকারি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে তা নয়, উল্টো এই অর্থ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হচ্ছে চোরাই টাকার মালিকদের। তারপর এর ঘাটতি পূরণ করতে নেয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ।

প্রতিবছর বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, অনেক প্রকল্পের সমাবেশ। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও অনেক প্রশ্ন ওঠেছে। বাজেট বাস্তবায়ন বলতে যে আলোচনা করা হয় তাতে বরাদ্দকৃত টাকা খরচই সাধারণত বোঝানো হয়। প্রতি বছরেই জুন মাসের মধ্যে বরাদ্দ টাকার শতকরা ৮০/৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়, যদিও এপ্রিল মাস নাগাদ শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ খরচ হয়। খরচ সম্পন্ন হওয়া আর প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া এক কথা নয়। বহুবছরের বাজেটের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, খুব কম প্রকল্পই বাস্তবায়িত হচ্ছে, যদিও খরচ হয় পুরোটাই। এর ফলে পরবর্তী বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচি পূর্ণ হয় পূর্ববতী বছরের অসমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী তার প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই অবস্থার পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চার বছর পর সর্বশেষ তিনি যে বাজেট উপহার দিলেন সেখানে পরিস্থিতি একইরকম আছে। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগের একটু বেশি, আমরা জানি জুন পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটের পুরোটা খরচ হবে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ এই বছরের কিংবা আরও পুরনো অসমাপ্ত প্রকল্প। নতুনের সাথে অনেকগুলো অসমাপ্ত প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে সামনের বছরের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি’।

অথচ গত বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানাবিধ নীতি, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ‘দাতাসংস্থা’ বলে পরিচিত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ‘নজরদারি’র নানা শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের ‘ক্রয় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ’ জারি হয়েছে, সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে বিদেশে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, এগুলোতেও বছর বছর বিদেশি ঋণসহ বরাদ্দ কম দেয়া হয়নি। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্স নামে বিদেশি ঋণ অনুদান, সেমিনার- ওয়ার্কশপ, বিদেশি কনসালট্যান্ট আনা, গাড়িকেনা, বিদেশ সফর, সবই হয়েছে। এতসব প্রহরী, এতসব পরীক্ষা, তারপরও অর্থ খরচ হয়, যার যার ভাগও চলে যায়, কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। আমাদের জানানো হয় ‘বজ্র আটুনি ’ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ‘ফস্কা গেরো’। পাহারার খরচই কেবল বাড়লো, ফলাফল অনুল্লেখ্য কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে তার অধপতনের চিহ্ন!

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচিতে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের নামে বিভিন্ন প্রকল্প যুক্ত থাকে। সড়ক, সেতু, ভবন নির্মাণ থেকে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট পর্যন্ত সবই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। দরপত্র বাছাই, নানা কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। বিদেশি ঋণ যদি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যদি এর অনুপাত ১০ ভাগও হয় তাহলেও জটিলতা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, নানাবিধ কাগজপত্র তৈরির বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি থাকে, দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ে। বছরের পর বছর একই প্রকল্প বারবার আসে। সেতু অসমাপ্ত, রাস্তার খবর নাই, বাঁধ একটু হয়ে পড়ে আছে, ক্ষতিকর বাঁধে জলাবদ্ধতা স্থায়ী, হাসপাতালের ভবন একটু খাড়া কিন্তু যন্ত্রপাতি নাই, গ্যাসের লাইন শুরু কিন্তু শেষ নাই, গবেষণার ভবন আছে গবেষণার বরাদ্দ নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন নতুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা ও বিরাট বিরাট বরাদ্দ শুনে সবই ভাবে, এবারে বোধহয় উন্নয়নের নতুন একটি জোয়ার সৃষ্টি হবে, বরাদ্দ বেড়েছে, নতুন অনেক প্রকল্প মনে হয় যোগ হচ্ছে। কিন্তু যা আড়াল থাকে, জনগণের যা জানা হয় না তা হল নতুন বরাদ্দে বেশির ভাগ টাকা পুরনো প্রকল্পের জন্যই গেছে। খরচের ফিরিস্তি বেড়েছে, সেগুলোর নতুন বাজেট পাশ হয়েছে, নতুন ভাবে তা যুক্ত হয়েছে নতুন বছরের বাজেটের সাথে।

এ যেনো সেই কুমির আর শিয়ালের গল্প। ‘পন্ডিত’ শিয়ালের কাছে কুমির তার ৭ বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে দিয়ে গেল। মা কুমির প্রতিদিন একবার বাচ্চাদের খোঁজ নিয়ে যায়। প্রথম কিছুদিন সব ঠিকঠাক ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে ১টি করে বাচ্চা শিয়ালের খাদ্য হতে থাকে। চতুর শিয়াল সব শেষ করে না, রেখে দেয় ১টা। কুমির যখনই আসে, শিয়াল ঐ ১টি বাচ্চাই বারবার দেখায়, বলে এই তোমার বাচ্চা। কুমিরও খুশি মনে ফিরে যায়। শিয়ালের কাজে সে খুবই খুশি। আমাদের দশা সেই বোকা, অমনোযোগী, বিশ্বাসী কুমিরের মতো। কোন প্রশ্ন পর্যালোচনা, সংশয় নাই, আছে বোকা বিশ্বাস; পরিসংখ্যানের হৈ চৈ এ মাথায় কোনকিছুই কাজ করে না।

অনেকেই বলছেন বাস্তবায়নই হচ্ছে বাজেটের আসল সমস্যা। আসলেই কী তাই? অনুসন্ধানে দেখা যাবে বাস্তবায়নের সমস্যার অনেকখানি তৈরি হয় প্রকল্প নির্বাচন বা বাছাইয়ের মধ্যেই। ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর প্রকল্পের ভিড়। কারণ দলীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দেশি বিদেশি নানা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় প্রকল্প নির্বাচিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত আগে, বাছাই প্রক্রিয়া পরে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে ভাগীদারদের মধ্যে বিরোধও হয়, হলে প্রকল্প বাছাই দীর্ঘায়িত হয়।

প্রকল্প নিয়ে এসব অভিজ্ঞতার পরও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচি ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। জনগণের সাধ্যমতো সবকিছু দেবার পরও এর ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকাই ঘাটতি। ঘাটতির প্রধান কারণ ঋণের সুদ, এই ঘাটতির জন্য আবার ঋণ হবে, দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে। আমরা এখন ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রের মধ্যে। ২০১২-১৩ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, পরের অর্থবছরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাবেন। কোথায় কমেছে? প্রশাসনের শান শওকত কমেছে? গাড়ি কেনা কমলো? বিদেশ সফর কমলো? আউটসোর্সিংএর নামে প্রশাসনিক ব্যয়বৃদ্ধি কমলো? না এগুলোর কোনটাই কমে নাই। ‘অপ্রয়োজনীয় খরচ’ কমানোর চেষ্টা আমরা আগের বাজেটগুলোতেও দেখি। যেসব কাজ জনগণের প্রযোজন সেগুলোই যেনো অপ্রয়োজনীয় খরচ! তাই টাকার অভাব দেখা যায় সর্বজনের (পাবলিক) শিক্ষা ও চিকিৎসার বিকাশে, দেখা যায় জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান বিকাশে, দেখা যায় গবেষণায়, দেখা যায় জনস্বার্থ রক্ষার জনবল বিকাশে।

২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হ্রাসের চিত্র দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এই সময়ে মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে কমানো হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কমানো হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগে কমানো হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সমগ্র বাজেট হিসাবে প্রশাসনের খরচ বেড়েছে ১০৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরের মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে যেসব খাতে বরাদ্দ কমেছে সেগুলো হল: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় (৪৬৬ কোটি টাকা), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ (২০২ কোটি টাকা), শিক্ষা (৩০১ কোটি টাকা), পানি সম্পদ (৪০৭ কোটি টাকা), কৃষি (৯০ কোটি টাকা)। রেন্টাল কৃইক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতে বেড়েছে ৬৭১ কোটি টাকা, কিন্তু খনিজসম্পদ বিভাগে কমেছে ২২২ কোটি টাকা। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সড়ক বিভাগে বেড়েছে ৯৮৩ কোটি টাকা, কিন্তু রেলপথে কমেছে ২৮৮ কোটি টাকা (বাজেট বক্তৃতা, ৭ জুন, ২০১৩)।

সামনের বছরের জন্য সমগ্র বাজেটের সম্পদের ব্যবহারের যে চিত্র বাজেট বক্তৃতায় উপস্থিত করা হয়েছে তাতে দেখা যায় সবচাইতে বেশি খরচ হচ্ছে ঋণের সুদ বাবদ, প্রায় ২৭,৪৪৩ কোটি টাকা (১২.৫%)। গত কয়েক বছরে ঋণজর্জরিত হয়ে গেছে বাজেট, তার কারণে সুদ দিতে হচ্ছে মোট আয়ের একটি বড় অংশ, রাজস্ব আয়ের বিচারে শতকরা ২০ ভাগের বেশি। এই ঋণবৃদ্ধির কারণ জনগণের প্রয়োজন মেটানো নয়।

গত কয়েক বছরে বেশি ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। ২০১২ সালে মোট ভর্তুকি ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ২৮ হাজার কোটি টাকাই ছিল রেন্টাল কুইক। রেন্টাল থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা ও তাদের জন্য বর্ধিত তেল আমদানির ব্যয় বাবদ এই বিপুল পরিমাণ টাকা সরকার জোগাড় করেছে ঋণ করে। এই ঋণের বোঝাটা শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরই পড়েছে। এর কারণে এই বছরের বাজেটে সুদ পরিশোধটাই হচ্ছে প্রশাসনের পরে সবচেয়ে বড় খাত। অথচ এককালীন সর্বোচ্চ ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের নবায়ন, মেরামত ও সংস্কার করলে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। তাতে বছর বছর এই ভর্তুকির বোঝা বাড়ত না, ঋণ বাড়ত না। বাড়তি তেল আমদানির বাধ্যবাধকতা তৈরি হতো না। অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হতো না। বরাদ্দ দেখে মনে হবে বিদ্যুৎএ সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছু গোষ্ঠীকে ব্যবসা দিতে গিয়ে এই ব্যয়বৃদ্ধি। যার ফল ঋণের ফাঁদ, আর কিছুদিন পরপর বিদ্যুৎ ও তেলের দামবৃদ্ধি।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিৎকার ও বিতর্ক কম হয় না। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির অর্থ কী? জিডিপির হিসাব দিয়ে জনগণের জীবনের গুণগত মান পরিমাপ করা যায় না। প্রবৃদ্ধিই শেষ কথা নয়, কী কাজ করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়ি ঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্ণিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি এর সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারী অর্থনীতি, আতংকের সমাজ, আর সন্ত্রাসের রাজনীতি সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়। সরকারকে যারা বছরে লক্ষ কোটি দিয়ে পালেন, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাহলে প্রাপ্তি কী?

(জুন ১২,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)