কর্তৃত্ববাদী সময় কিংবা ‘উন্নয়ন’

বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশেনির্বাচনী কর্তৃত্ববাদবিষয়ে এক গবেষণা গ্রন্থে বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে : ”নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ বা ইলেক্টোরাল অথরিটারিয়ানিজমে জনপ্রতিনিধি সরকারপ্রধান নির্বাচিত করার জন্য নিয়মিতই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ন্যায্যতার উদার গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে এমন ব্যাপক পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করা হয় যে, নির্বাচন বিষয়টিগণতন্ত্রের হাতিয়ারে বদলে কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়।গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী শাসনে নির্বাচন মোটা দাগে অংশগ্রহণমূলক হয় (সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি থাকে), নূ্যনতম প্রতিযোগিতামূলক (বিরোধী দলগুলোকে জয়লাভ করতে দেওয়া না হলেও নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়) নূ্যনতম উন্মুক্ত (বিরোধী দলগুলোকে সর্বাত্মক দমনপীড়ন চালানো হয় না; কিন্তু বাছাই করে মাঝেমধ্যেই দমনপীড়ন করা হয়) থাকে। তবে সব মিলিয়ে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় এত মারাত্মক, ব্যাপক পদ্ধতিগতভাবে রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তার করা হয় যে, তখন আর তাকে গণতান্ত্রিক বলা চলে না। কর্তৃত্ববাদী প্রভাব বিস্তার নানাভাবেই করা হয়। কিন্তু সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য থাকে নির্বাচনী ফলাফলের অনিশ্চয়তাকে মোকাবিলা করা।

এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যবস্থায়বৈষম্যমূলক নির্বাচনী আইন, বিরোধী দল প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখা, তাদের রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তাদের গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ অর্থ সংগ্রহে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সমর্থকদের ভোটাধিকারে আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক নানা উপায়ে বাধাদান, ভয়ভীতি কিংবা প্রলোভনের মাধ্যমে পক্ষত্যাগ করানো কিংবা স্রেফ ভোট জালিয়াতি করা‘- সবই হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, “রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের পথ হিসেবে বহুদলীয় প্রতিযোগিতাকে স্বীকার করে নিয়ে নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী সরকার রাজনৈতিক বিরোধিতার আইনি বৈধতা প্রদান করে। যদিও তারা বিরোধী শক্তিকে তাদের নিজেদের সুবিধামতো আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি বিরোধী দল গড়ে তোলা হয় এবং তাদের জন্য সুবিধাজনক আদর্শিক অবস্থানও বরাদ্দ করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রেসমস্যাজনকবিরোধী দল প্রার্থীদের সরিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করা হয়।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ”নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদেসুলতানি প্রবণতাদেখা যেতে পারে, যেখানে পরিবারতান্ত্রিক শাসকরা নিয়মিত বহুদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার বৈধতা আদায় করে নেয়। কর্তৃত্ববাদী নির্বাচনের সাংগঠনিক প্রয়োজনে এই ব্যক্তিবাদেরও অবশ্য একটা সীমা থাকে। নিয়ন্ত্রিত বহুদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে শাসকরা শাসনকার্য চালাতে চান, ভোটার জোগাড়ের জন্য তাদের একটা পার্টি (এবং সহযোগী রাষ্ট্র) প্রয়োজন হয় এবং নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা রাষ্ট্র (এবং সহযোগী পার্টি) প্রয়োজন হয়।” (দেখুন :’নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ‘, আন্দ্রেয়াস স্কেডলার সম্পাদিতদ্য লজিক অব ইলেক্টোরাল অথরিটারিয়ানিজমগ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, অনুবাদ :কল্লোল মোস্তফা, ‘সর্বজনকথা‘, ফেব্রুয়ারিএপ্রিল ২০১৯)

বর্ণনা শুনলে প্রথমে আমাদের বাংলাদেশের কথাই মনে হবে। তবে বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা আগের যে কোনো অবস্থা থেকে নতুন এক পর্বে প্রবেশ করেছে। সাধারণভাবে বাংলাদেশে ত্রুটিযুক্ত যে নির্বাচন ব্যবস্থার ধারা ছিল; ২০১৮ সালের নির্বাচন তাও যেন অতিক্রম করেছে। এক কথায় বলা যায়, দেশে নির্বাচন নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। জাতীয় নির্বাচনের পর অন্যান্য নির্বাচনে তাই নাগরিকরা এর জবাব দিয়েছেন নির্বাচনে অনুপস্থিতি দিয়ে। নির্বাচন বয়কটের এই প্রতিবাদে সরকার নিজের ভূমিকায় কোনোভাবে অনুতপ্ত বা বিব্রত তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

উন্নয়ন‘-এর ওপর খুব জোর দিচ্ছে বর্তমান সরকার। উন্নয়ন প্রকল্প যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয়, তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যে কোনো পরিমাণ ব্যয় বরাদ্দ, যে কোনো শর্তে ঋণ গ্রহণ, যে কোনো দমনপীড়নে কোনো কার্পণ্য বা দ্বিধা নেই। ইতোমধ্যে বহু প্রকল্পে বিশ্বে সর্বোচ্চ ব্যয়ের রেকর্ড হয়ে গেছে বাংলাদেশের। পেঁয়াজের দাম বিশ্বরেকর্ড করেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভর্তি, নিয়োগসবই এখন টাকার খেলা। সরকার নিজে গ্যাসবিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে বারবার, করশুল্ক্ক বাড়াচ্ছে। জিডিপি বাড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সন্ত্রাসে জননিরাপত্তা বিপন্ন। একে একে সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ছে; কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন দশক আমাদের এটাই প্রথম নয়। এর আগে আমাদের আরও দুটি উন্নয়ন দশকের অভিজ্ঞতা আছে। প্রথমটি ছিল জেনারেল আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক (১৯৫৮৬৮), দ্বিতীয়টি উন্নয়নের প্রায় দশক, সেটি ছিল জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন (১৯৮২৯০) আগের দুটি উন্নয়ন দশকেও গণতন্ত্র নিয়ে রকম কথা আমরা শুনেছি। আইয়ুব খান উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত রাখার জন্য চালু করেছিলেন তার স্ব্বৈরশাসনের উপযোগী সংস্করণ মৌলিক গণতন্ত্র। এর বৈশিষ্ট ছিল, জেনারেল আইয়ুবের পকেটবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাদের দুর্নীতির পথ করে দেওয়া হয়েছিল। জেনারেল এরশাদও একই পথে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। উপজেলা নির্বাচন দিয়ে তার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক জাতীয় গণপ্রতিরোধের কারণে তার পরিকল্পনা পুরো বাস্তবায়ন হয়নি।

এই তিনউন্নয়নদশকেই আমরা রাস্তাঘাট আর ভবন নির্মাণের ব্যাপক উদ্যোগ দেখি। আর সর্বজনের সম্পদ ব্যক্তি বা কোম্পানির মুনাফার সামগ্রী বানানোও এই দশকগুলোর এক অভিন্ন ধারা। তিন আমলেই গাড়ি যোগাযোগ গুরুত্ব পেয়েছে; সর্বজনের প্রয়োজন নয়, রেল বা নৌপথ নয়।

বাংলাদেশের যোগাযোগের সবচেয়ে কার্যকর, সুলভ সহজ যোগাযোগমাধ্যম হতে পারত নৌপথ। এর পর রেলপথ। কিন্তু এতে ঋণদাতা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার কারও জন্য বিশেষ সুবিধা হতো না। ঋণদাতাদের তাগিদ ছিল গাড়ি বিক্রি; তা হয়েছে। রাস্তা বেড়েছে, গাড়ি বেড়েছে, ব্যয় বেড়েছে, জমি হারিয়েছে, দূষণ বেড়েছে, জটও বেড়েছে। অনেক নদীখাল এগুলোর জন্য মৃতপ্রায়।

জেনারেল আইয়ুবের সময় পূর্ব পাকিস্তানের এক বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প ছিলকাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই বাঁধে ভেসে গিয়েছিল রাঙামাটি শহর। এতে লক্ষাধিক চাকমা, মারমাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদি অশান্তি, বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য পাহাড়ি জাতির সঙ্গে সহিংস সম্পর্ক, বহু মানুষের হত্যাকাণ্ড, সামরিকীকরণ, সামরিক ব্যয় বৃদ্ধিসবকিছুর সূচনা এই পরিণাম বিবেচনাহীনউন্নয়নপ্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে বনপাহাড় উজাড় হয়েছে, অশান্তি চিরস্থায়ী হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন কখনোই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি।

জেনারেল এরশাদের সময়ে দেশের তেলগ্যাস খাত ২৩টি ব্লকে ভাগ করে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার সূচনা হয়। সিমিটার নামে অখ্যাত এক কোম্পানির হাতে বাংলাদেশের একমাত্র হরিপুর তেলক্ষেত্র তুলে দেওয়ার আয়োজন করে। রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায় অস্বচ্ছতা, কমিশননির্ভর চুক্তি, ঘুষদুর্নীতি অভূতপূর্ব হারে বেড়ে যায়। স্বৈরতন্ত্র উপযোগী প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার পক্ষে ধর্মের ব্যবহারও শুরু হয় ব্যাপকভাবে।

বর্তমান উন্নয়ন দশকে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ বাস্তবায়নের শুরু জ্বালানি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়েরদায়মুক্তি আইনপাস করার মধ্য দিয়ে। এই আইন হলো দেশের নাগরিকদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার পথ বন্ধ করার বিধান, মন্ত্রণালয় যত অপকর্ম বা সর্বনাশ করুক, নাগরিকদের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় নেই। এই আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই সরকার বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নামে বিভিন্ন ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করেছে। রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ী, বাঁশখালীসহ জবাবদিহিহীন ভয়াবহ প্রকল্পের কাজ এরই আশ্রয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম এবং তথ্য বিকৃতি প্রথম থেকেই চলছে। চলছে গায়ের জোর। গায়ের জোরে জমি দখল, গায়ের জোরে তথ্যউপাত্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাবিশ্নেষণ অস্বীকার, গায়ের জোরে ভুল আর মিথ্যা ভরা ইআইএ পাস, গায়ের জোরে নিয়ম ভেঙে চুক্তি, গায়ের জোরে কোম্পানির জন্য শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা, গায়ের জোরে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি, ভাড়াটে মাস্তানপরামর্শকের দাপট তৈরি

এই প্রক্রিয়াতেই দেশে সরকার আছে; কিন্তু অবৈধভাবে কারখানা চলে, অবৈধভাবে গাড়ি চলে, অবৈধ তালিকা তৈরি হয়, বিদেশি কোম্পানি অবৈধভাবে বাংলাদেশের সম্পদ দেখিয়ে বিদেশে শেয়ার ব্যবসা করে, অবৈধভাবে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়, অবৈধভাবে প্রকল্প পাস হয়, অবৈধভাবে নির্মাণ কাজ হয়, অবৈধ কমিশন টাকা লেনদেন চলে, অবৈধ মামলা আটক বাণিজ্য চলে এর ফলে দেশের মানুষ মরতে থাকে অকালে। নিরাপত্তাহীনতা ভর করে ঘরে ঘরে, দেশের প্রাণপ্রকৃতি ধ্বংস হয়। ওদিকে সরকার নিজেকেউন্নয়নের সরকারবলে ঢোল পেটাতে থাকে। বিজ্ঞাপনের জোয়ারে ভেসে যায় দেশ। কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করে বাংলাদেশ!

(২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)