মা-বাবার বাইরে আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক বা ওস্তাদ আমাদের পাড়ার বিখ্যাত মাটির মসজিদের ইমাম সাহেব। তাঁকে আমরা ওস্তাদজি বলেই ডাকতাম। এখন কয়েকতলা ভবন এবং সুউচ্চ মিনারের মসজিদ হলেও তখন সেটা আসলেই মাটির মসজিদ ছিল। মাটির ঘরে মূল মসজিদ, আর সামনে ছিল খোলা জায়গা, এক পাশে পুকুর। খোলা জায়গা, পুকুর আর নেই। বহুতল ভবনের মধ্যে যথারীতি হারিয়ে গেছে।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই এ মসজিদে গেছি ওস্তাদজির কাছে। আরো কয়েকজনের সঙ্গে তখন আমপারা, সিপারা পড়ি, ধাপে ধাপে কোরআন শরিফ শিখি তাঁর কাছেই। নামাজ তো ছিলই। তখন অনেক বয়স্ক মনে হলেও এখন বুঝি, তিনি ছিলেন আসলে তরুণ একজন ইমাম। তাঁর কাছে শিক্ষা নিতে মসজিদে যেতে কখনো আপত্তি করিনি, বরং আগ্রহ নিয়েই যেতাম। আমরা তাঁকে খুবই পছন্দ করতাম। তার কারণ বোধ হয় এটাই যে তিনি খুব সহজ, স্বচ্ছন্দ এবং আলাপী ছিলেন। গল্প করতেন, ফুটবল খেলা এবং সাতারেও তার আগ্রহ ছিল। পরে জেনেছি তার বিরুদ্ধে অনৈসলামিক তত্পরতার অভিযোগ আনা হয়, এর সপক্ষে খেলা ও সাঁতারে তার বিশেষ আগ্রহের কথাই বলা হয়। এ কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন! এরপর তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। বলাই বাহুল্য, তাকে হারিয়ে আমরা সবাই খুব দুঃখিত হয়েছিলাম।
ওস্তাদ শব্দের ব্যবহার করে কাউকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্বোধন করা আমার সেটাই শেষ। এর পরে পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম ‘ওস্তাদজির কদর’। সম্রাট আওরঙ্গজেব কীভাবে রাজপুত্রকে ওস্তাদ বা শিক্ষককে সম্মান করতে শিখিয়েছিলেন তার গল্প। ছোটবেলায় এ গল্প একটা ভাবনার বিষয় ছিল। এরপর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকদের স্যার বলেছি, সেটাই নিয়ম ছিল, এখনো প্রধানত তা-ই।
বাঙালি সমাজে সব শিক্ষককে ওস্তাদ বলার রেওয়াজ কখনই ছিল না। আমার অভিজ্ঞতার দেখেছি, মসজিদ-মাদ্রাসা-মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষকদেরই ওস্তাদ বলার চর্চা ছিল। এখনো হয়তো তা-ই। মাদ্রাসায় এখন হুজুর বলার চল বেশি। এর বাইরে অন্যান্য শিক্ষককে স্যার বলা শুরু হয়েছে বেশ আগেই। বিভিন্ন স্কুলে সমাজে ‘মাস্টার সাহেব’, ‘মাস্টার মশাই’, ‘পণ্ডিত মশাই’ বলার চল ছিল বেশি।
তবে এখনো গানের শিক্ষকদের ঠিকই ওস্তাদ বলা হয়। গানের জগতে ‘ওস্তাদজি’ বলার চল অনেক বিস্তৃত। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশেই সুরের শিক্ষকরা ওস্তাদ হিসেবেই অভিহিত হন। তাদের অনেকের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় ‘ওস্তাদ’ শব্দটি। শিষ্য ছাড়া অন্যরাও তাদের ওস্তাদ বলে অভিহিত করতেই অভ্যস্ত হয়ে যান। গানে-সুরে আগ্রহী মানুষদের কাছে এ ওস্তাদদের কদর কখনই কমে না।
তবে ওস্তাদ শব্দের আরো বহুবিধ ব্যবহার আছে। ওস্তাদ মানে সবসময় শুধু শিক্ষক বোঝানো নাও হতে পারে, এর সঙ্গে যোগ হতে পারে অভিভাবক, হতে পারে পথপ্রদর্শকের ভূমিকাও। গানের শিক্ষকতার জগৎ ছাড়া, বহুবিধ অর্থে এ শব্দের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার সম্ভবত পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে। পরিবহন খাতে বহু স্তরের বহু মানুষের অংশগ্রহণ ঘটে। গাড়ির চালক, পরিচালক, হেলপার, মেকানিক; আবার এ ক’টি ভাগের মধ্যেও বহু স্তরের বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এখানেই বিভিন্ন ধাপের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের সম্বোধন হলো: ‘ওস্তাদ’।
এ দেশে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য ভেসে ভেসে অসংখ্য পরিবার শহরে আসে। আসার আগে, সময়ে বা পরে বহু পরিবার ভেঙে পড়ে। পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত শিশুরা এদিক-সেদিক ছিটকে পড়ে। শিশুকাল থেকেই অনেককে টিকে থাকার যুদ্ধে নামতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খাদ্য ও আশ্রয়ের বিনিময়ে কাজ জোটে শিশু-কিশোরদের। কারো না কারো ওপর ভর করতে হয়। পরিবহন খাতেই খেলার বয়সী, স্কুলে যাওয়ার বয়সী এদের অনেককে পাওয়া যায়। তখন বয়সে বড় ড্রাইভার, মেকানিক হয়ে যায় শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী বা কর্মসন্ধানীদের ওস্তাদ।
ওস্তাদের সমার্থক শব্দ যদি হয় শিক্ষক, তাহলে এ ওস্তাদ শিক্ষকের শিক্ষাদানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই, কিন্তু এ শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনের অস্তিত্বের অংশ। শিক্ষার্থীকে কোনো কিছু শেখানোতে ওস্তাদের কোনো দায় নেই, তার ভরণ-পোষণ নিয়েও তার কোনো গোছানো বা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নেই। তার পরও এ ওস্তাদের ওপর ভর করেই শিক্ষার্থীর জীবন এগিয়ে চলে, আবার বিপরীতে এসব শিক্ষার্থীর ওপর ভরসা করেই ওস্তাদ কাজকর্মে সক্রিয় থাকতে পারে। বাস, ট্রাক, টেম্পোসহ নানা ধরনের পরিবহন, গ্যারেজ চালু রাখায় প্রায় বিনা বেতনে কাজ করা শিশু-কিশোরদের অবদান অসামান্য। বিনা বেতনে হলেও এরা এসব কাজে লেগে থাকে ওস্তাদ অভিহিত কারো না কারো সাহচর্যের জন্য, তার কাছে কাজ শিখে ভবিষ্যৎ জীবন তৈরি করতে। এ জগতে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ক্লাসরুমে বা কোনো সিলেবাস ধরে হয় না, তা চলতে থাকে কাজের মধ্যে, চলার মধ্যে, আড্ডার মধ্যে, ওস্তাদের সেবা করতে করতে, কখনো মার খেতে খেতে। খাওয়া না খাওয়া, নির্যাতন অবহেলা, আবার প্রশ্রয়-আশ্রয়ের মধ্যেই ওস্তাদ-শিষ্য সম্পর্ক অগ্রসর হয়। শিষ্য ক্রমে নতুন ওস্তাদের জায়গায় যেতে থাকে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়।
পাড়ার মাস্তানদের মধ্যেও ওস্তাদ-শিষ্যের চল আছে। মস্তানি সন্ত্রাসী গুণ্ডাবাজির এখন যে নৃশংস চেহারা দেখা যায়, এটা খুব বেশি দিনের নয়। এখন সমাজপ্রভু বা তাদের বস/বড়ভাই/ওস্তাদদের খাই বেড়েছে বহুগুণ, প্রতাপ বেড়েছে, যোগাযোগ বেড়েছে, অস্ত্র মাদকের জোগান ‘উন্নত’ আর বিস্তৃত হয়েছে, সন্ত্রাসী তত্পরতাও চাহিদা অনুযায়ী নৃশংস হয়েছে। এ জগতেও ওস্তাদ শব্দ এখনো শোনা যায়। তবে বস, বড়ভাই এখন বেশি। তার আবার অনেক স্তর, অনেক ধাপে তার ক্রিয়া। এ জগতেও নতুন যারা ঢোকে, তারা আসলেই শিষ্য হিসেবে ওস্তাদ ধরে কাউকে। তবে বলা যায় না, কবে সেই শিষ্যই ওস্তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়!
ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আছে এ স্তরবিন্যাস। কে কাকে ধরে সিঁড়ি খোঁজে, তার ওপরই ঠিক হয় ওস্তাদ-শিষ্য সম্পর্ক। ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া লুটপাট, জমি-খাল-বিল দখল, ব্যাংক ডাকাতি, বন-নদী বিনাশ করা যায় না। আর এগুলো না করলে টাকার পাহাড় বানানো যায় না। সুতরাং ধাপে ধাপে তৈরি হয় ওস্তাদ, ছোট-বড় নানা কিসিমের। এক বিষাক্ত সিঁড়ি, এখানে শুধুই অন্যায়, শুধুই মানুষ-প্রকৃতি সর্বনাশের পরিকল্পনা। মন্ত্রী, আমলা, নেতা, ব্যবসায়ীদের নানা দুষ্টচক্র কাজ করতে থাকে এ জগতে। ওস্তাদ শব্দ অনেকে এখন ব্যবহার করে না, যথেষ্ট আধুনিক মনে হয় না হয়তো। এখন তার বদলে বস, লিডার, নেতা, বড়ভাই, স্যার এগুলোই বেশি।
ওস্তাদ আছে দেশে, ওস্তাদ আছে বিশ্বে। ক্ষমতাবানদের কাছে ওস্তাদ মানে হলো প্রভু। বাংলাদেশের শাসকদের জন্য ভারতের শাসকরা ওস্তাদ, ওস্তাদ যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, সরকার নির্বিশেষে দেশের নীতিনির্ধারকদের ওস্তাদ। তারা শিখিয়ে দেয়, পথ দেখায়। কীভাবে উন্নয়নের জামা পরিয়ে দখল করতে হয়, কীভাবে প্রগতির কথা বলে জনগণের জীবন অভিশপ্ত করতে হয়।
ওস্তাদ তাই আমার দেখা প্রাণবন্ত নিঃস্বার্থ শিক্ষক শুধু নন, কিংবা ওস্তাদ মানে শুধু সুরের মায়ায় অসুর ভেদ করার আশ্রয় নন, ওস্তাদ মানে অনাত্মীয় শহরে ভরসাস্থল নন শুধু। কে কোন পথ খোঁজে, কার মাথা কোথায় বাঁধা পড়ে, কার কাছে দুনিয়া কীরূপে হাজির হয়, তার ওপরই ওস্তাদের নির্বাচন ঘটে, আর ধরনও নির্মিত হয় সেভাবেই।
(১৯ নভেম্বর ২০১৯, দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত)