এটি কার্যত দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন

সরকার সম্প্রতি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন’–এর মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিপন্থী এই আইনের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ও সামগ্রিকভাবে দেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ।

wasif

প্রথম আলো : জ্বালানি খাত নিয়ে এ রকম আইনের ঊর্ধ্বের ‘আইন’ প্রণয়নের প্রয়োজন হলো কেন?
আনু মুহাম্মদ : দুর্নীতি ও অনিয়ম করার জন্য বেপরোয়া না হলে এ রকম আইন করার দরকার ছিল না। এই আইন করার আগের, এমনকি এই সরকারের আগের সরকারগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির অনেক ঘটনা সবাই জানেন। কিন্তু এই আইন অনেক বেশি দুর্নীতির পথ তৈরি করেছে, যথেচ্ছাচারের সুযোগ দিয়েছে। ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি’ নয়, এটি কার্যত ‘দ্রুত লুণ্ঠন ও দুর্নীতি দায়মুক্তি আইন’। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ–সংকট নিরসনের অজুহাতে আইন প্রণয়নের সময়ই আমরা আশঙ্কা জানিয়েছি যে, এই আইন বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধান তো দেবেই না, উল্টো সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্ম দেবে। পরের বছরগুলোয় এই আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই অনিয়মের ধারাবাহিকতা আরও চার বছর চালিয়ে যেতে চায় বলেই সরকার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, গোপন চুক্তি ও সমঝোতার দুষ্টচক্রের গোড়া জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে সব আইনি বাধ্যবাধকতার ওপর স্থাপন করে দুর্নীতি আর জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতাকে অবাধ করতে চায় সরকার।

প্রথম আলো : জ্বালানি খাতে কী ধরনের দুর্নীতিকে রক্ষা করছে এই আইন?
আনু মুহাম্মদ : শতকরা ৮০ ভাগ গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রেখে সমুদ্রে গ্যাস ব্লক কনোকোফিলিপসকে প্রদান, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালমুখী তৎপরতা, কেয়ার্ন এনার্জি ও হেলিবার্টনের সঙ্গে আত্মঘাতী চুক্তি স্বাক্ষর, শেভরন ও নাইকোর কাছ থেকে গ্যাস ধ্বংসের জন্য প্রাপ্য ৫০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের উদ্যোগ না নিয়ে শেভরনের জন্য সুবিধা বৃদ্ধি, সমুদ্রসম্পদ বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা, ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে এশিয়া এনার্জির বেআইনি শেয়ার ব্যবসা ও লবিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতা, সুন্দরবন ধ্বংস করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি কমিশন ও দুর্নীতি ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়। এসবকে বাধাহীন করতেই এই আইন।

প্রথম আলো : সমস্যা নিরসনে অন্য বিকল্প কী ছিল?
আনু মুহাম্মদ : স্বল্প মেয়াদে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন এবং প্রয়োজনীয় মেরামত ও নবায়ন করলে একই পরিমাণ গ্যাসে কমপক্ষে এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। এবং এর উৎপাদন খরচ হতো ইউনিটপ্রতি দুই টাকা। তা না করে আট গুণ বেশি দামে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ফাঁদে ফেলা হয়েছে দেশকে। অথচ বিদ্যুৎ পাচ্ছি তুলনায় কম। নাইকোর সঙ্গে বিরোধের জেরে ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এসব থেকেই প্রতিদিন ৩০ কোটি ঘনফুট বাড়তি গ্যাস মিলত। ব্যয়ও হতো তুলনায় অনেক কম। অথচ এই পথে দুর্নীতি ও কমিশনের সুযোগ কম বলে সরকারের উৎসাহও কম। অর্থের অভাবের কথাও ঠিক নয়। কারণ, এর চেয়ে ২০ গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ের পথেই তো সরকার চলছে।

প্রথম আলো : বিদ্যুৎ খাত এ রকম দুস্থ দশায় পড়া কি অনিবার্য ছিল?
আনু মুহাম্মদ : না, ছিল না। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে স্বল্পদামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই সম্ভব। আশির দশক থেকেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত বহুজাতিক পুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়ার নীতি প্রণয়ন শুরু হয়। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী বরাবরই জাতীয় মালিকানা ও জাতীয় সক্ষমতার বিরোধী। আর বিভিন্ন সরকার ও দেশি লুটেরা গোষ্ঠী লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও কমিশনের লোভে এই নীতি অনুসরণ করেছে। এখান থেকেই দুস্থ দশার শুরু। দেড় দশক আগে ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’, ‘গ্যাস রপ্তানি করলে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন করতে সক্ষম হবে, না করলে সর্বনাশ হবে’—এমন সব রব তুলে একসময় দেশের সীমিত গ্যাসসম্পদ বিদেশে পাচারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রচারকেরাই এখন বলছেন, দেশে গ্যাস মজুত খুবই কম, বিদ্যুৎ-সংকট কাটানোর জন্য অবিলম্বে বিদেশি কোম্পানির হাতে কয়লাখনি তুলে দিতে হবে, সমুদ্রবক্ষের গ্যাসসম্পদ নিয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আরও সুবিধা দিয়ে চুক্তি করতে হবে। তাদের মুখস্থ বুলি: আমাদের সক্ষমতা নেই, পুঁজি নেই। আসলে সংকট থাকলেই এদের জন্য সুযোগ আসে।

প্রথম আলো : অর্থনীতির চাপের তুলনায় কুইক রেন্টালের অবদান কতটা?
আনু মুহাম্মদ : পিডিবির ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ছয় হাজার ৬০১ মেগাওয়াট। কুইক রেন্টালের অবদান এর শতকরা ২০ ভাগেরও কম। অথচ বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই এর পেছনে যাচ্ছে। উপরন্তু, এগুলো নির্ভরযোগ্য নয়, অনেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বিল নিচ্ছে। (আরও বিস্তারিত দেখুন: (http://ncbd.org)

প্রথম আলো : জাতীয় কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনাদের সমালোচনা যতটা আদর্শবাদী, ততটা বাস্তববাদী না।
আনু মুহাম্মদ : বাস্তবতা হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত দেশি-বিদেশি লুটেরাদের রাহুগ্রাসে। সমুদ্র, সুন্দরবনসহ দেশ ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির বোঝাও ক্রমবর্ধমান। বাস্তববাদী হওয়া বলতে যদি কেউ মনে করে সর্বনাশের মুখে চোখ-মুখ বন্ধ করে রাখা, তাহলে আমরা সে রকম বাস্তববাদী নই। আমরা এই বাস্তবতা পাল্টাতে চাই। জ্বালানি সম্পদের ওপর শতভাগ মালিকানা, রপ্তানি নিষিদ্ধ ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়নের পথেই স্বল্পদামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জোগানো ও জ্বালানিনিরাপত্তা সম্ভব। যেসব দেশ এগুলো করতে পারেনি, সম্পদ এবং দারিদ্র্য ও সহিংসতা সেখানে একসঙ্গেই আছে। সম্পদ সেসব দেশে অভিশাপ। ‘বাস্তববাদী’ লোকজন যেখানে চুপ করে থেকেছে বা তাল মিলিয়েছে; সম্পদশালী আফ্রিকা তার করুণ উদাহরণ। মিয়ানমারের অভিজ্ঞতাও একই রকম।

প্রথম আলো : আপনাদের আইনি প্রস্তাব কী?
আনু মুহাম্মদ : দুর্নীতি করার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন করুন। বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ও বিদ্যুৎ খাতকে কিছু গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি করার বিদ্যমান নীতি, চুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করুন। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের চুক্তি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু, মেরামত ও নবায়ন করুন। দীর্ঘ মেয়াদে বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করার কাজ শুরু করুন। বঙ্গোপসাগরের গ্যাস দেশের কাজে লাগানোর মহাপরিকল্পনা নিন। বিদেশি কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে কাজ করা বন্ধ করুন। আশু প্রয়োজন মেটানোর জন্য কয়লা আমদানিভিত্তিক না করে গ্যাস আমদানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট করুন। জাতীয় সম্পদের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য বাপেক্স, পেট্রোবাংলা, জিওলজিক্যাল সার্ভে, ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্টসহ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটাতে উদ্যোগ নিন। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও তার সর্বোত্তম ব্যবহারের জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আরও বিভাগ এবং জাতীয়ভাবে বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করুন। এ কাজে প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ও প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগান। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও বর্জ্যসম্পদের বিশাল ভান্ডার কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিন। নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানিনীতি প্রণয়ন করে তার জন্য প্রয়োজনীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ শুরু করুন।
পাঠকদের কাছে আমার প্রশ্ন, এগুলো কি অবাস্তব মনে হয়, না দেশের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য করণীয় মনে হয়?

(আগস্ট ৩১, ২০১৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)