একটি ভয়ংকর অনিশ্চয়তা বা নিরাপত্তাহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতি কারও ঠেকানোর উপায় নেই। বড় দলগুলো দেশকে নৈরাজ্য আর সহিংসতায় ডুবিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। প্রতিটি মানুষ দিনযাপন করছেন আতংকের মধ্যে। সবচেয়ে বড় বিপদজনক বিষয় হলো, দিনশেষে কোনো আলোর দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলতে পারছে না এই নৈরাজ্যের অবসান হবে কবে, কীভাবে?
স্বাধীনতার পর থেকে ৪২ বছর পার হলো। মুক্তিযুদ্ধের কথা, তার চেতনার কথা আমরা সবসময় শুনি। কিন্তু বরাবর তার বিরুদ্ধেই সব সরকারের ভূমিকা দেখেছি। দেশ ও দেশের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার বদলে তা কেড়ে নেয়া হয়েছে দেশি ও বিদেশি লুটেরাদের দখলে। বিপুল বিত্ত নিয়ে চোরাই টাকার মালিকদের আধিপত্য তৈরি হয়েছে সমাজে। জনগণের সাধারণ সম্পত্তি দখল ও লুন্ঠনে কোনো সরকারের ভিন্ন ভূমিকা দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, এসব কাজে সরকার ও বিরোধী দলে ঐক্যেরও কোনো অভাব দেখা যায়নি। দেশব্যাপী সংঘাত সত্ত্বেও অপকর্মে তাদের সেই ঐক্য তৎপরতা এখনো অব্যাহত। দেশের মানুষ যখন সংঘাত সহিংসতায় ত্রস্ত, ভীত তখনও জাতীয় স্বার্থবিরোধী নানা চুক্তি নিয়ে কাজ করছে সরকার ও নানাগোষ্ঠী, সমর্থন আসছে প্রধান বিরোধী দল থেকে। আর গত চার দশকে এই জনবিরোধী রাজনীতির ফাঁকেই জায়গা করে নিয়েছে যুদ্ধাপরাধীরা।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা সবাই বলেন। কিন্তু স্থিতিশীলতাই যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট শর্ত নয় সেটাও বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তথাকথিত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও অনেক অনিয়ম ও জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতা চলতে পারে। যেমন আপাত স্থিতিশীল অবস্থাতে জামায়াত শিবির কখনো আওয়ামী লীগ কখনো বিএনপির আশির্বাদ পেয়েছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে বহু জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি এই স্থিতিশীলতার সময়ই হয়েছে। স্থিতিশীল অবস্থায় পদ্মা সেতু নিয়ে একটা বড় ধরণের অনিয়ম ও জটিলতা হয়েছে; হলমার্কের কেলেংকারি হয়েছে, ডেসটিনির হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। স্থিতিশীল অবস্থায় তাজরীন গার্মেন্টসএ শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মরেছে, যাদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ এখনও দেয়া হয়নি। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও কর্তৃত্ব বিদেশিদের দেয়া, জালিয়াত বিদেশি কোম্পানির হাতে পানি মানুষ ও কৃষি ধ্বংস করে ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদ তুলে দেবার চক্রান্ত, শেয়ারবাজারে লক্ষ কোটি টাকা লুট, শিক্ষা, চিকিৎসাকে গলাকাটা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরিণত করা ইত্যাদি ভুল নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজে বড় দলগুলোর মধ্যে কোনো মতানৈক্য বা বিরোধ কখনোই দেখা যায়নি। জনগণকে তাই এদের সবার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে লড়াই করতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে।
নিরাপত্তা ও উন্নয়নের অনেক অর্থ আছে। দেশি বিদেশি লুটেরা, দখলদারদের কাছে যা উন্নয়ন, জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় তা ধ্বংস বা উন্নয়ন সম্ভাবনার বিনাশ। রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার বিন্যাসের প্রতিফলন হলো রাজনীতি। এই বিন্যাস রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান। আর অর্থনীতি হলো এই ক্ষমতার ভিত্তি। এখন কোন দল যদি ক্ষমতায় গিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি, আরও দখল আর লুটপাটে ব্যস্ত থাকে, যদি দলীয় বা গোষ্ঠিগত স্বার্থে সারাক্ষণ হানাহানিতে লিপ্ত থাকে, যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তাহলে দেশের মানুষ সার্বক্ষণিক একটি আক্রমণের হাত থেকে বাঁচবেন কী করে? শুধু তাই নয়, সরকারে যদি এ ধরণের তৎপরতাই মুখ্য হয় তাহলে তার নিজের মধ্যেও সারাক্ষণই সংঘাত থাকে। আমরা তাই সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠনে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে অর্থ লুট ভাগাভাগি নিয়ে সংঘাতে জড়িত হয়ে পড়তে দেখি। বিএনপি জামাত যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তাদের ক্ষেত্রেও এই একই অবস্থা দেখেছি।
তাই এটা না বলে উপায় নেই যে, দেশে এই ধরণের রাজনীতির আধিপত্য যতদিন থাকবে ততদিন পরিস্থিতির স্থায়ী কোন পরিবর্তন হবে না। সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে অরাজকতা চলতেই থাকবে। একটা বড় কারণ হলো, এসব দলের মাধ্যমে যে লুটেরা গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে, চোরাই কোটিপতিদের যে চক্র তৈরি হয়েছে তাদের বাসভূমি বা ভবিষ্যতের ঠিকানা অন্য দেশে। এই দেশ তাদের টাকা বানানোর জায়গা, ক্ষমতা চর্চার জায়গা, ঠিকানা অন্যত্র। সেজন্য এই দেশ গোল্লায় গেলে তাদের কিছু আসে যায় না। এই দেশে পানি বাতাস বন জঙ্গল নদী পাহাড় নষ্ট বা ধ্বংস করে, বা এই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে বা দেশের মানুষের ওপর ঋণের বোঝা তৈরি করে তারা সম্পদের পাহাড় বানায়। বারবার বড়দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে ভয়ংকর সংঘাত দেখি, সংঘাত ক্ষমতা নিয়ে, কে এই লুটের বড় ভাগীদার হবে তা নিয়ে। জনগণকে প্রতারিত করে দলে টানার জন্য সামনে তাদের নানা বাহানা, নানা মুখোশ, নানা শ্লোগান থাকে।
প্রয়োজন এমন রাজনীতির বিকাশ যা জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারবে বা জনগণের সাধারণ সম্পত্তিকে তার অধিকার হিসাবে রক্ষা করতে পারবে। দেশের সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া গণতন্ত্র কোথায় থাকে? চোরাই টাকার মালিক, দখলদার, লুটেরা, সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা নিয়ে সংঘাত চলবে যদি রাজনীতিতে এরকম শক্তিরই প্রাধান্য থাকে। এটা অব্যাহত থাকলে উন্নতিতো দূরের কথা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের প্রাত্যহিক জীবন হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। তাহলে দেশের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে। তাই বড় দলগুলোর তৈরি করা আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে না থেকে দলনির্বিশেষে এই লুটেরা জনশত্রু শ্রেণীকে সনাক্ত করা ও তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই আমাদের বিশেষ কর্তব্য।
জনগণের দিক থেকে চাওয়াটা খুব বেশি নয়। জনগণ চায় এমন একটি ন্যুনতম রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরী হোক এবং সেখানে তার বেঁচে থাকার মতো ন্যুনতম চাহিদা পুরণ হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের এই সামান্য আকাঙ্খা বাস্তবায়ন হওয়ারও কোন সুযোগ থাকছে না। জনগণের দিক থেকে তাদের কোন মতামত দেয়ার বা ভূমিকা পালনের সুযোগও ক্রমেই সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
পরিস্থিতিতে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে বাড়তে সবাই আশঙ্কা করছে দেশ একটি দাঙ্গা বা গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকাতে আমরা যেমন দেখি, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যে ধরণের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বা সংঘর্ষ হয় সেই রকম গোষ্ঠিগত সংঘাতের দিকে বাংলাদেশ কেনো যাবে? এখানে তো কোন গোত্রীয় বিবাদের অবস্থা নেই। কিন্তু এখানে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাবান আর ক্ষমতা বহির্ভূত গোষ্ঠির মধ্যে সেই ধরণের স্থায়ী দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে খেলা করছে অনেক দেশী বিদেশী শক্তি। তারা আসলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে।
এখন এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ হবে তার পথ বের করবে কে? যারা পর্দার আড়ালে খেলা খেলছে তারা করবে না। যারা ক্ষমতায় থাকার বা যাবার জন্য উন্মাদ তারাও করবে না। যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায়, তারাও কোনো সমাধান চাইবে না। সুতরাং বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যারা ভুক্তভোগি তাদের স্বাধীন চিন্তা ছাড়া কীভাবে এই পথ বের হবে? বাঁচতে হলে তাদের অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী, লুটেরা দূর্নীতিবাজ শাসক শোষক গোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যান করবার শক্তি অর্জন করতে হবে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য দেশের সর্বত্র জনগণের শক্তিকে গড়ে তুলতে হবে তাদের স্বার্থের চিন্তা ও রাজনীতির ভিত্তিতে। লুটেরাদের তৈরি করা সংঘাতে জনগণ বলি হবে না এটাও জোরগলায় বলার অবস্থা তৈরি করতে হবে। দেশ ও দেশের সম্পদের মালিক জনগণ এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির আধিপত্য তৈরি করা ছাড়া আমাদের রুটিনমতো ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।।
(মার্চ ২৭,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)