ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্র কার জন্য

অর্থনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাতও নিছক অর্থনীতির বিষয় নয়, এটা সমাজের শক্তি সমাবেশ ও ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্তমানে যেভাবে চলছে, অনেকের উৎপাদিত সম্পদ কিছুজনের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া কিংবা কিছুজনের স্বার্থে বহুজনের জীবন বিপন্ন করা কোনো স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়। তা নির্দিষ্ট নীতি, পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডের ফল। বাংলাদেশে সরকার তার নীতিদর্শন অনুযায়ী দেশে লুম্পেন পুঁজিপতি বিকাশে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সর্বজনের সম্পদ কিছুজনের হাতে পৌঁছানো তাই সরকার দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। বর্তমান বাজেট তারই একটি আইনি ব্যবস্থা মাত্র।

সম্পদ স্থানান্তরের আইনি ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক আছে। মুদ্রা ব্যবস্থাও তার একটি। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত দি ইকোনমিক কনসিকুয়েন্স অব পিস গ্রন্থে কেইনস বলেছিলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির অব্যাহত চাপ রেখে সরকারগুলো খুব গোপনে, অলক্ষে তাদের নাগরিকদের সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হজম করে ফেলে। এ পদ্ধতিতে হজম বা বাজেয়াপ্ত করার এ ঘটনা ঘটে নির্বিচারে। এ প্রক্রিয়ায় যখন বহুসংখ্যক মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তখন কিছুসংখ্যক সম্পদশালী হয়।’ মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্নভাবে ঘটে বা ঘটানো হয়। এর মাত্রা সব ক্ষেত্রে এক রকম হয় না, আবার তা সবসময় খোলামেলাও থাকে না। টাকার মূল্যমানের অবনতি বিভিন্ন সময় ঘটানো হয়েছে, আরো প্রস্তাব আছে। টাকার তুলনায় ডলারের দাম ক্রমে বেড়ে গেলে রফতানিকারক গার্মেন্টস মালিকদের আয় বাড়ে। কিন্তু তাতে দেশের শ্রমিকসহ সবার আপেক্ষিক আয় কমে। আমদানিকৃত দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় থেকে শুরু করে গৃহস্থালি ব্যয় সবকিছুই বাড়ে, সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ বাড়ে।

আরেকটি ব্যবস্থা রাজস্বনীতি। বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয়, তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর শুল্ক ও ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয়? সেটি হলো সরকারি প্রশাসন—প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। সরকারি আধা সরকারি প্রতিটি গাড়ি, প্রতিটি ভবন, এসি, সভা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, বিলাস, অপচয়, জীবনযাপন, বিদেশ সফর, কেনাকাটা প্রকৃতপক্ষে জনগণের অর্থেই পরিচালিত হয়। জনগণ হয়তো খেয়াল করেন না যে, তাদের ঘরের ওপর বুলডোজার, তাদের মাথায় পুলিশ বা র্যাবের লাঠি, তাদের সামনে মন্ত্রী-এমপি আমলার চোটপাট কিংবা শান-শওকত, নতুন নতুন ভবন, দামি গাড়ি সবই তাদের অর্থেই হয়।

জনগণের কাছ থেকে কর শুল্ক সারচার্জ বা বর্ধিত দাম আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের সাধারণত কোনো ব্যর্থতা দেখা যায় না। সরকার জনগণের কাছ থেকে যা চেয়েছে, তা দিতে তারা কখনো আপত্তি করেনি। কিন্তু জনগণের পাওনা পরিশোধ করেনি কোনো সরকারই। বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর শুল্ক দেয়, তা গত ১০ বছরে প্রায় ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর করসহ রাজস্ব আয় দাঁড়াচ্ছে ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেট প্রস্তাবেও করজাল সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

তবে জনগণের দেয়া এখানেই শেষ হবে না। এবারো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভুল নীতি, ক্ষতিকর চুক্তি ও দুর্নীতির কারণে যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তার চাপ কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছরের মতো এবারো তা করা হচ্ছে বাজেট ঘোষণার বাইরে। এগুলো নতুন কর শুল্কের চেয়েও ব্যাপকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। শিল্পকৃষিসহ সব উৎপাদনশীল খাত আরো কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবে।

যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদাংশ, তারা কিন্তু এখনো করজালের বাইরে। দেশের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন সরকারের হিসাবে নেই। এ আয়ের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপ্রদর্শিত আয়’, অর্থশাস্ত্রে এর আরেকটি নাম ‘কালো টাকা’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, বিভিন্ন কারণে কর না দেয়ার কারণে তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, এ টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’, যা চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতা প্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজনের সম্পদ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। সবাই জানে, এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না। এ বিরাট অংশের টাকা যেভাবে উপার্জিত হয়; তাতে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব বিস্তৃত হওয়া আর সন্ত্রাসী বাহিনীর পুনরুৎপাদনই স্বাভাবিক।

বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল শেয়ারবাজারে। চোরাই টাকা তো ছিলই, দেশের সব প্রান্তের সব আয়ের মানুষ যেন তাদের সহায়-সম্বল নিয়ে শেয়ারবাজারে হাজির হয়, তার জন্য সরকারই সব রকম ব্যবস্থা করেছিল। ব্যাংক বা সরকারি সঞ্চয়ের সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়েছিল, জেলায় জেলায় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছিল ইত্যাদি। কাজ নেই, দ্রুত আয়ের তাগিদ আর এসব সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে সব রকম সঞ্চয় ও ঋণ নিয়ে মানুষ জমায়েত হয়েছিল শেয়ারবাজারে। তারপর শুরু হলো পতন। দ্রুত দেশের লাখ লাখ মানুষের সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে গেল কিছু ব্যক্তির হাতে। সরকার বলতে থাকল, আমাদের কিছু করার নেই। তদন্ত কমিটি কিছু কারণ বের করল, কিছু গোষ্ঠীকে চিহ্নিতও করল। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলে পণ করেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আর প্রকাশিত হয়নি।

এতে লাখ লাখ পরিবার অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছে, সম্পদের বদলে তাদের ঘাড়ে এখন ঋণ, স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে হাহাকার। ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা তরুণদের মধ্যেও এদের সন্ধান পাওয়া যাবে। এমএলএম নামের দ্রুত টাকা বানানোর নানা প্রক্রিয়ায়ও অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে। প্রায়ই তাদের হাহাকার পত্রিকায় আসে, শহীদ মিনারে তারা অনশন করে। সরকার নির্লিপ্ত, মাঝে মধ্যে মুখের দুয়েকটা কথা। কারণ বোধগম্য, এসবের সঙ্গে নানা প্রভাবশালী লোক জড়িত।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অবস্থা ভালো। তার প্রধান উৎস দুটি: এক. প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং দুই. গার্মেন্টস রফতানি। এ দুই খাতে দিবা-রাত্রি শ্রম দিচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তুলছে। আর যাদের সম্পদের পাহাড়ের নিরাপত্তার জন্য এ মজুদের বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা হাজারও হবে না।

দেশের বৈদেশিক ঋণ, যা ‘বিদেশী সাহায্য’ নামে পরিচিত, তার জন্য অনেকের হাহাকার শুনি। কিন্তু আমরা যদি বছরে গড়পড়তা নিট বৈদেশিক তহবিল প্রবাহ বিবেচনা করি, তাহলে তার ১০ গুণ বেশি অর্থ প্রবাসীদের থেকেই আসে। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে আইএমএফের কাছ থেকে বহু রকম শর্ত ও আওয়াজ দিয়ে যে পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়েছে, তা প্রবাসীরা প্রতি এক মাসের কম সময়েই দেশে পাঠাতেন। আইএমএফ এ ঋণ দিয়েছে তিন বছরে অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করার পর। অর্থাৎ তার প্রতি বছরে ছাড় করা ডলার ছিল প্রবাসীদের প্রতি ১০ দিনে পাঠানো অর্থের সমান। অথচ এ ঋণ পাওয়ার জন্য শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় সবই বেড়েছে।

ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে সরকারের অতিআগ্রহ বহুদিক থেকেই বিপদ ডেকে আনছে। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ভারতের কাছ থেকেই ঋণ নেয়া হয়েছে। সে ঋণ অনুযায়ী এমনকি নির্মাণসামগ্রীও তাদের কাছ থেকেই আনতে হচ্ছে। সুদও দিতে হবে, জরিমানাও। রামপাল প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ব্যাংক এবং রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল ঋণ নেয়া হচ্ছে। চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পে। দেশের ব্যাংক থেকেও সরকার ঋণ গ্রহণে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সামনের বাজেটে আরো রেকর্ড করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

জনস্বার্থবিরোধী নীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশ যেভাবে ক্রমেই ঋণনির্ভর হচ্ছে এবং সেই ঋণের টাকায়, কমিশন দুর্নীতিতে যে রকম শান-শওকত চলছে, তাতে গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে। ‘গণি মিয়া’ ছিলেন একজন কৃষক। তার গল্প ছোটবেলায় আমরা অনেকেই পড়েছি। কৃষক হিসেবে তিনি মোটামুটি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসের প্রতি তার বিশেষ আসক্তি ছিল। কৃষির আয় থেকে তা সম্ভব ছিল না। গল্পে আছে, তার আসক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ঋণ করে হলেও ঘি খেতেন। ঋণের টাকা খুব সহজ, ব্যয়ের সময় গায়ে লাগে না। কিন্তু ঋণ বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে সুদও। যখন সেই ঋণ শোধের সময় হলো, তখনই হলো বিপত্তি। সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করতে করতে ফতুর হলেন তিনি। ঋণ করে ঘি খেয়ে শেষে পথে বসলেন কৃষক গণি মিয়া। কিন্তু এ ‘গণি মিয়ার’ সঙ্গে সরকারের পার্থক্য নেই? গুরুতর পার্থক্য আছে।

গণি মিয়া ঋণ করে নিজে ভোগ করেছেন, নিজেই তার মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যে ঋণের বোঝা তৈরি করছেন, তাতে তার বা তাদের কোনো ঝুঁকি বা বিপদ নেই, মাশুলও তাদের দিতে হবে না। কতিপয় গোষ্ঠী বা সরকারের কতিপয় লোকজন সুবিধা ভোগ করবে ঠিকই। কিন্তু এ ঋণ ও তার ব্যয় সম্পর্কে জানার বা এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়ার কোনো এখতিয়ার যাদের নেই, মাশুল দিতে হচ্ছে ও হবে সেই জনগণকেই।

ব্যাংক থেকেও নানাভাবে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি হাওয়া হয়ে গেল। দেশ থেকে ক’বছরে পাচার হয়েছে চলতি বছরের বাজেটের মোট পরিমাণের চেয়ে বেশি অর্থ। এ টাকাই তৈরি করেছে চোরাই কোটিপতিদের, কিন্তু তার বোঝা টানতে হবে জনগণকেই।
(০৩ জুলাই ২০১৯ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তায়  প্রকাশিত)