ভারত বাংলাদেশকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে, দিচ্ছে। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বসবাস করলে খাঁচায় বসবাসের অনুভূতি হয়, আমারও তাই হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বন্ধুত্বের আহবান নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। কিন্তু খাঁচা থেকে আমরা কী করে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবো?
আমাদের সমুদ্রসীমায় ভারত দাবি জানিয়েছে, মায়ানমারও আমাদের সীমায় দাবি উপস্থিত করেছে, তাতেও মূল ভূমিকা পালন করেছে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাই। ভারত ও মায়ানমারের এই দাবির ফলে আমাদের সমুদ্রসীমার এক বড় অংশ হুমকির মুখে। বঙ্গোপসাগরে একদিকে ভারত ও মায়ানমারের দাবি অন্যদিকে মার্কিনীদের হাতে সরকারের গ্যাসব্লক তুলে দেয়ার ফলে পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশের সমুদ্রে বাংলাদেশেরই দাঁড়ানো অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
কাঁটাতার দেয়া সীমান্তে হত্যাকান্ড এখনো বন্ধ হয়নি। এখন আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে অনেকক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে বেয়োনেট ও লাঠি। নিহত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভারত রাষ্ট্রের অভিযোগ তারা সন্ত্রাসী কিংবা চোরাচালানী। দেশের মধ্যে রাবের হাতে যারাই খুন হয় তারা যেমন সন্ত্রাসী হয়ে যায়, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তেমনি। ১২ বছরের বালিকারও নিষ্কৃতি নেই এই অপবাদ থেকে। আর চোরাচালানী কি এই গরীব মানুষেরাই করে? তাতে শুধু কি বাংলাদেশের লোকজনই জড়িত থাকে? সীমান্তে কখনো বাংলাদেশ বাহিনীর হাতে ভারতীয় নিহত হয় না, কিন্তু নিয়মিতভাবে নিহত ও জখম হয় বাংলাদেশের কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের গরীব মানুষ। বর্তমানে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বৈধ বাণিজ্য ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি, এর শতকরা ১০ ভাগ বাংলাদেশ রফতানি করে। ধারণা করা হয় অবৈধ বাণিজ্য এর প্রায় সমপরিমাণ কিংবা আরও বেশি। এই বাণিজ্য ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে, বাংলাদেশে তৈরি করছে তাদেরই বাজার। প্রাথমিক লাভ ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরই।
ভারতের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশ অনেক উন্মুক্ত, অনেক উদার। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য, বিনিয়োগ, শ্রম, পরিষেবা, প্রতিষ্ঠান আসায় কোন বাধা নেই, বাংলাদেশে ভারতের বহুসংখ্যক টিভি চ্যানেল দেখতে কোন বাধা নেই। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্য থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল পর্যন্ত সবকিছুতেই নানাবিধ বাধা আছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা অবিরাম ভারতে উৎপাদিত পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখি, এর মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের বাজার সম্পসারিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে কার্যত নিষিদ্ধ থাকায় এখানকার পণ্যের খবর ভারতে যায় না। নৌপথে ভারত ট্রানজিট সুবিধা অনেক আগে থেকেই পাচ্ছে, এখন পেতে যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথে, কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ নেপাল বা ভূটানে যাবার জন্য ভারতের ৩০/৪০ কিমি ব্যবহার শুরু করতে পারেনি।
ভারতের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেধরনের ‘ট্রানজিট’ প্রস্তুতি চলছে তার কোন তুল্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। একমাত্র কাছাকাছি হল দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চারদিকে ঘেরাও হয়ে থাকা লেসোথো। কিন্তু এটিও তুলনীয় নয়; কারণ, সোনার খনি নিয়েও লেসোথো রাষ্ট্র হিসেবে প্রায় ভেঙে পড়েছে, আয়ুসীমা ৩৪ বছর, মারিজুয়ানা চাষের উপর নির্ভর অনেক কর্মসংস্থান, আর লেসোথোর মানুষ নিজেরাই দক্ষিণ আফ্রিকার দশম প্রদেশ হবার আবেদন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও এর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না দুটো কারণে। প্রথমত, দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এতটা অসমতা নেই, যেটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আছে। দ্বিতীয়ত, সেখানে কোন দেশই অন্যদেশের ভূমি বা নৌপথ ব্যবহার করে নিজদেশেরই অন্য প্রান্তে যায় না, যায় তৃতীয় কোন দেশে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অবাধ যোগাযোগ ভারতের জন্য অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সবদিক থেকেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যদি ভারতকে এই সুবিধা দেয় তাহলে ভারতের পরিবহণ ব্যয় কমে যাবে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি, অর্থাৎ আগে যে পণ্য পরিবহণে খরচ হতো ১০০ টাকা তার খরচ দাঁড়াবে ৩০ টাকারও কম। এছাড়া সময় লাগবে আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ, বা চারভাগের এক ভাগ। এই সময় ও অর্থ সাশ্রয় বহুগুণে তাদের অর্থনেতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে কাজে লাগবে। ভারতের এত লাভ যেখানে, বাংলাদেশের সেখানে প্রাপ্তি কী? আমাদের সার্ভিস ও অবকাঠামোর সুযোগ ব্যয় কত? কী কী লাভ, আর কী কী ক্ষতি বা সমস্যা? কোনটার চাইতে কোনটা বেশি?
‘ট্রানজিটের’ লাভক্ষতি নিয়ে সরকার থেকে কোন হিসাবনিকাশ আমাদের জানানো হয়নি। অথচ মন্ত্রী কিংবা বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য খুব লাভজনক, দেয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার লাভের অংক। কীভাবে ট্রানজিট বিষয়ে দুইদেশের সরকারের বিস্তারিত সিদ্ধান্তের আগে এবিষয়ে অংক দেয়া যায় তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে ভারতের সাথে সব চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাঁরা ইতিমধ্যে অনেক কথা বলেছেন, তা থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, যেকাজে তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিষয় তাদেঁর কাছে বোধগম্য নয়। আরও পরিষ্কার হয়েছে যে, তাঁরা যেকোন মূল্যে চুক্তি করতে অতি আগ্রহী, এবং নিশ্চিত যে, ভারতই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। উপদেষ্টা মশিউর রহমান এতদূর বললেন যে, সভ্যদেশ হিসাবে বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি চাইতেই পারে না। অবশ্য পরে ফি নির্ধারণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ট্রানজিট নিয়ে নতুন কোন চুক্তিরই দরকার নেই, ১৯৭২ সালেই সব চুক্তি করা আছে! যাদের দরকষাকষি করবার কথা, তারাই যদি আগে থেকে বলতে থাকেন এতে বাংলাদেশেরই লাভ হবে, তাহলে দরকষাকষির আর কী সুযোগ থাকে?
শুধু গাড়িভাড়া বন্দরভাড়া হিসাব করলেই তো হবে না। আগপাছ বিচার না করে শুধু টাকার জন্য নিজের যেকোন কিছু ভাড়া দেয়া একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব নয়। সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য তো তা আরও অচিন্তনীয়। তাই শুধু টাকার প্রশ্ন নয়, বাংলাদেশের জন্য আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জমি সীমিত, আবাদী জমি নষ্ট করা তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের ক্রমবর্ধমান পণ্য পরিবহণ করতে গিয়ে যে সড়ক স¤প্রসারণ ও সংযোজন করতে হবে তা কত কৃষিজমি জলাভূমি বিনাশ করবে? এরফলে খাদ্যসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন, জীববৈচিত্র কত বিনষ্ট হবে? কত পরিবেশ দূষণ হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজের পণ্য পরিবহণ ভবিষ্যতে অনেক বাড়বে। এখনই বিভিন্ন রাস্তায় জটের কারণে পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হয়, পচনশীল দ্রব্য বিনষ্ট হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়ে। ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমাদের পণ্যপ্রবাহে কীরকম সমস্যা তৈরি হতে পারে? তৃতীয়ত, যে রাজ্যগুলোতে ভারত পণ্য নিয়ে যাবে, সেসব রাজ্য এতদিন ছিল বাংলাদেশের বহু শিল্পপণ্যের বাজার। সেই বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে, সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। তার ক্ষতি কত? চতুর্থত, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে ‘সন্ত্রাসী’ বিবেচনা করে তিনদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে রাখে, সেখানে বাংলাদেশ ভেদ করে তার পণ্য পরিবহণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কে করবে? কী পণ্য ভারত নিয়ে যাচ্ছে তার তদারকির ব্যবস্থা কী থাকবে? পঞ্চমত, নদী, সমুদ্র, কাঁটাতার, অসম প্রবেশাধিকার, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আগে সমাধান কেন নয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ভারতের কাছ থেকে কঠোর শর্তযুক্ত ঋণ নেবার চুক্তি হয়েছে তাদেরই কাঙ্খিত পণ্য পরিবহণব্যবস্থা দাঁড় করবার জন্য। মাত্র ১০০ কোটি ডলারের এরকম শর্তযুক্ত ঋণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কমই আছে, যেখানে সবকিছু ভারত থেকে কিনতে হবে, সব সিদ্ধান্ত তাদের। বাংলাদেশের দায়িত্ব শুধু তাদের নির্দেশমতো কাজ করা এবং সময়মতো সুদসমেত ঋণের টাকা ফেরত দেয়া। এই ঋণকেই বিশাল অর্জন বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
ট্রানজিট নিয়ে লাভের নানা কাল্পনিক হিসাব দিতে ব্যস্ত না থেকে নীতিনির্ধারকরা নানা সমাধান খুঁজতে পারতেন। ভারতের প্রয়োজন ও বাংলাদেশের জটিলতায় না পড়বার মতো একটা সমাধান হতে পারতো – সীমান্ত জুড়ে বাংলাদেশের প্রান্তে বিশাল শিল্প বেল্ট তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ। কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকারে ভারত যদি অনুকূল অবস্থান নেয়, তাহলে বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী কিংবা যৌথ উদ্যোগে এই রাজ্যগুলোর চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের বিস্তার খুবই সম্ভব। বর্তমানে এসব রাজ্যে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য সরবরাহ সাফল্যে এই সক্ষমতার ইঙ্গিত আছে। ভারতকে তাহলে এতদূর পণ্য টেনে আনার কষ্ট করতে হতো না, বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি শক্তিশালী হতো, আবার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অর্থনীতিও চাঙ্গা হতো। কিন্তু ভারতের আগ্রহ নেই এরকম কোন কিছুই আলোচনার টেবিলে নেই।
শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, আমি উন্মুক্ত বিশ্বের পক্ষে। আমি চাই, সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত থাকুক, সারাবিশ্বও বাংলাদেশের কাছে উন্মুক্ত হোক। আমরা ভারত চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের শক্তিশালী ও ক্ষমতাবানদের জন্য দরজা জানালা সব খুলে দিলাম, আর এসব দেশে বাংলাদেশের পণ্য ও মানুষের প্রবেশাধিকার কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিতই থাকলো- এটা উন্মুক্ত হওয়া নয়। উন্মুক্ত হওয়া আর আত্মসমর্পণ কিংবা অধীনস্থ হওয়া এক কথা নয়। এই দুইএর পার্থক্য বোঝার মতো আত্মসম্মানবোধ আমাদের মধ্যে তৈরি হওয়া দরকার।
(সেপ্টেম্বর ৫, ২০১১ bdnews24.com এ প্রকাশিত)