
প্রথম ধাক্কা খেয়েছিলাম ফয়’স লেকের অবস্থা দেখে। এর আগে একবার সুযোগ হয়েছিল অবিকৃত প্রাকৃতিক ফয়’স লেকে যাওয়ার। সে কারণেই উন্নয়নের নামে বিকৃতি প্রথমেই চোখে পড়ল। রংচং দিয়ে বীভৎস গেট বানানো হয়েছে দর্শক ঠেকিয়ে টাকা নেওয়ার জন্য। ভেতরে তথাকথিত পর্যটনসামগ্রী- বোট, রাইড, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। সব জায়গাতেই টিকিট। পুরো এলাকা বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের দখলে; নানা স্থাপনা করে ঢেকে ফেলা হয়েছে প্রকৃতি। আগে লেক-পাহাড়ের যে অসাধারণ রূপ দেখেছিলাম, তা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। কীভাবে এই ঘটনা ঘটল, ঘটতে পারল? জানলাম, বেসরকারি এক কোম্পানিকে এই এলাকা লিজ দেওয়া হয়েছে, অবশ্য উন্নয়নেরই নামে! তাদের মুনাফার জোগান দিতে গিয়ে একদিকে মানুষের প্রবেশ সংকুচিত ও ব্যয়বহুল হয়েছে, অন্যদিকে পুরো অঞ্চল তার প্রাকৃতিক সমৃদ্ধ চেহারা হারিয়ে বিকৃত বেশ ধরেছে। জানা গেছে, এই লিজ নেওয়ার সময় যে চুক্তি করেছিল কোম্পানিটি, তা একের পর এক ভঙ্গ করে গাছপালা-টিলা কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে; লেকের পানি দূষিত করেছে। এগুলো জানা কথাই। এর ক্ষতিপূরণ আদৌ হবে কিনা, বলা কঠিন।
বলাই বাহুল্য, এ জন্য শুধু বেসরকারি কোম্পানিটি নয়; যারা চুক্তি করেছিল তারাও দায়ী। সে কারণে এই অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে আরও জোর কদমে চট্টগ্রামে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে যাচাই-বাছাই, পরিণতি বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মতামতকেও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরও দুটি সর্বনাশা উন্নয়ন প্রকল্প। এর একটি হলো সিআরবি নামে পরিচিত চট্টগ্রামের একটি উন্মুক্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিক হাসপাতাল নির্মাণ। আরেকটি হলো পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত একটি বেসরকারি কোম্পানির কাছে ইজারাদান।
সিআরবি নামে পরিচিত ২১০ একরজুড়ে বিস্তৃত উন্মুক্ত স্থান, যেখানে আছে ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, শতবর্ষী শিরীষ, গর্জন, কড়ইসহ ১৯৭ প্রজাতির গাছপালা। প্রকৃতপক্ষে এই এলাকা হলো চট্টগ্রাম নগরবাসীর জন্য প্রাকৃতিক হাসপাতাল এবং আনন্দ-অবসর-আরামের স্থান, যেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ আসেন সুস্থ থাকার জন্য। নগরীর বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এখানে হয়ে থাকে। এই বিশাল আশ্রয় ভেঙে বাণিজ্যিক হাসপাতাল বানানোর জন্য এ অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চুক্তি করেছে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে। চট্টগ্রামের প্রায় সব মহল থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে; এখনও এটা বাতিল করা হয়নি।
অথচ এই নির্মাণ চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনারই বিরোধী। কেননা, চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন মাস্টারপ্ল্যান (১৯৯৫)-এর সুপারিশ ছিল: ১) সিআরবি ভবনকে ঐতিহাসিক ভবন হিসেবে সংরক্ষণ, ২) সিআরবি ও বাটালি হিল এলাকাকে তাৎপর্যপূর্ণ মুক্ত এলাকা হিসেবে সংরক্ষণ এবং ৩) বিশেষ বিবেচনায় উক্ত এলাকাকে ‘উন্মুক্ত স্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করে সব ধরনের নির্মাণকাজ নিয়ন্ত্রণ করা। একই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের বিস্তৃত অঞ্চল পরিকল্পনা বা ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’-এ সিআরবিকে ‘সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত সংরক্ষিত’ এলাকা হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকল্পটি হচ্ছে- চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইজারাদান। এখানেও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কর্তৃক শহর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা এবং বিস্তৃত অঞ্চল পরিকল্পনায় পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতকে ‘পাবলিক ওপেন স্পেস’ বা ‘সর্বজনের উন্মুক্ত স্থান’ হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা আছে। অথচ উল্টো কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়িক কোম্পানির কাছে এটি ইজারাদানে ব্যস্ত! এসব অপকর্মে তো যুক্তির কোনো অভাব নেই। বলা হচ্ছে, এই সৈকতে অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু এর জন্য সরকারের অর্থ নেই! তাই ইজারা দিয়ে তাদের মুনাফা লাভের ব্যবস্থা করলে তারা সৈকতের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দায়িত্ব নেবে। তাদের কাছে সমুদ্রসৈকতের উন্নয়ন মানে কী? হবে শপিংমল, পার্কিং জোন, সৈকত এলাকায় টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কেবল কার বা টয় ট্রেন। আর ইজারা দেওয়া প্রান্তে মানুষকে ঢুকতে হবে অর্থ দিয়ে। প্রাকৃতিক উন্মুক্ত স্থানে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ বা টিকিট ধার্য করার ব্যবস্থা সর্বজনের কাছ থেকে তার এলাকা কেড়ে নিয়ে মুনাফাসন্ধানী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার একটা পথ। এর মধ্য দিয়ে সর্বজনের স্বীকৃত প্রবেশাধিকার হরণ করা হবে; প্রাকৃতিক সৈকতের বিকৃতি ঘটবে; সঙ্গে সঙ্গে একই সৈকতে দুই ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। তার মানে, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নামে ইজারা দিলে তা সর্বজনের উন্মুক্ত স্থানে সর্বজনের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করবে। ব্যয়বহুল প্রবেশ আর মুনাফার টানে নানাকিছু করতে গিয়ে সৈকতের প্রকৃত রূপ ও শক্তি বিপর্যস্ত হবে। তা ছাড়া উন্মুক্ত পতেঙ্গা সৈকতকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ যে জীবিকা নির্বাহ করে, তাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত কয় বছরে চট্টগ্রামে আমরা বেশক’টি পাহাড় ধসের ঘটনা দেখেছি। যার কারণে নির্মম মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের প্রতিক্রিয়ায় পাহাড় ধস, ভবন ধসের পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে শহরে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এক আমলা বলেছেন, ‘এখানে প্রায়ই ভূমিধস হচ্ছে, মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এসব থেকে বাঁচার জন্য সহজ সমাধানে যেতে হবে আমাদের, শহরের ভেতর পাহাড় রাখার দরকার কী, এগুলো কেটে ফেললে ওখানে মানুষের থাকার ব্যবস্থাও হবে আর ভূমিধস থেকেও বাঁচা যাবে।’ চিন্তা করা যায়! এরকম দায়িত্বহীন লোকের হাতে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সর্বনাশ কে ঠেকাবে? নিশ্চয় এ ধরনের লোক দ্বারা সরকার পরিচালিত হলে বা ক্ষমতার জায়গায় এ ধরনের লোক থাকলে কিছু গোষ্ঠী নিশ্চয় খুশি হবে- জমি দখলে উন্মুখ দখলদার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, কমিশন খাওয়া নেতৃবৃন্দ, দখলকাজের সহযোগী সন্ত্রাসী বাহিনী সবাই।
প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রামের এই পরিণতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উন্নয়নের নামে মুনাফা তাণ্ডবের একটি খণ্ড দৃশ্য। বাংলাদেশের উপকূল যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, তখন সেই উপকূলজুড়ে সুন্দরবন এলাকা থেকে বাঁশখালী মাতারবাড়ী, পায়রাসহ একের পর এক নির্মাণ করা হচ্ছে এমন সব প্রকল্প, যা উপকূল এলাকাকে ভয়াবহ মাত্রায় আরও ঝুঁকিপূর্ণ করতে যাচ্ছে। সুন্দরবনসহ উপকূলবিনাশী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো অবশ্যম্ভাবীরূপে পুরো বাংলাদেশকে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর বাইরেও রূপপুরের পর আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানাসহ পরিবেশ বিনাশকারী নানা প্রকল্প নিয়ে দখলদার দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে পুরো উপকূলকে, মানে বাংলাদেশকে।
চট্টগ্রাম পার হয়ে কক্সবাজার সেন্টমার্টিন এলাকায়ও একই পরিস্থিতি। সেখানেও উন্নয়নের নামে বিপজ্জনক সব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বিশাল অঞ্চল বনভূমিতে আমলাদের জন্য প্রশিক্ষণ ভবন, কক্সবাজার সি-বিচজুড়ে যথেচ্ছাচার হোটেল, বিমানবন্দর, সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। কক্সবাজার সেন্টমার্টিন দ্বীপাঞ্চল প্রতিবেশগত দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ এবং একই সঙ্গে খুবই নাজুক। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবেচনা না করে পর্যটন বিকাশের নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ব্যবসা দিতে গিয়ে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে; আমরা যে কী হারাতে যাচ্ছি, তা নীতিনির্ধারকদের না বোঝার কথা নয়।
প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদনদী, খালবিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং উন্মুক্ত স্থান সর্বজনের। এগুলো ব্যক্তিগত তো নয়ই; সরকার বা রাষ্ট্রেরও ব্যবসায়িক সম্পত্তি বানানোর অধিকার নেই। সরকারের দায়িত্ব কেবল তার সুরক্ষা করা। দেশের সংবিধান ও বিভিন্ন নীতি-পরিকল্পনা, আদালতের রায় ইত্যাদিতেও এর স্বীকৃতি আছে। কিন্তু সরকারের যাত্রা উল্টো। আইন, বিধান, জনস্বার্থ সবকিছু অগ্রাহ্য করে কিছু গোষ্ঠীর মুনাফা ও দখলদারিত্বের জন্য সর্বজনের সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেওয়ায় মূল ভূমিকা পালন করছে সরকার।
উন্নয়ন মানে আনন্দ, সর্বজনের সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, সুস্থতা। যা দেশ ও জনপদকে বিপন্ন করে, তাকে কখনোই উন্নয়ন বলা যায় না। যারা এই সর্বনাশ করছে; তাদের কাছে বাংলাদেশ হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দ্রুত বিত্ত বানানোর জায়গা। তারা নিজেদের ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ দেখে অন্য দেশে। ক্ষমতাবানরা যখন এ রকম সর্বনাশা কাজে লিপ্ত হয়, তখন সর্বজনের আশ্রয় রক্ষার জন্য উন্নয়নের বাদ্য-বাজনার বিপরীতে এগুলোর বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সজাগ ও সক্রিয় করার দায়িত্ব সর্বজনের প্রতিনিধিদের। বিভীষিকার হাত থেকে চট্টগ্রাম তথা দেশকে বাঁচাতে কণ্ঠ সোচ্চার, কলম-তুলি সক্রিয় এবং সংগঠিত প্রতিরোধের আর বিকল্প কী আছে?
[১ মার্চ ২০২২ দৈনিক সমকাল পত্রিয়ায় প্রকাশিত]
[১ মার্চ ২০২২ দৈনিক সমকাল পত্রিয়ায় প্রকাশিত]