‘উন্নয়ন’ শব্দটি সবার জন্য একই অর্থ বহন করে না। উন্নয়ন কি সবার জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, নাকি বহুজনের জীবন ও প্রকৃতির বিনিময়ে কতিপয়কে দানব বানাবে— এটি নির্ভর করে উন্নয়নের ধরন কেমন আর তার গতিপথ কারা নির্ধারণ করছে তার ওপর। পুঁজির স্বৈরশাসনের মধ্যে যখন আমরা বাস করি, তখন যেকোনো উপায়ে পুঁজির সংবর্ধনকেই ‘উন্নয়ন’ নাম দিয়ে আমাদের সামনে হাজির করা হয়। তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন, প্রচারণার আচ্ছন্নতার কারণে উন্নয়নের সঙ্গে ধ্বংস বা বিপন্নতার পার্থক্য ধরতে সমাজ ব্যর্থ হয়।
বর্তমানে যে উন্নয়নধারা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এখন মহাদাপট নিয়ে কর্তৃত্ব করছে, তার পোশাকি নাম ‘নয়া উদারতাবাদ’। পুঁজিবাদের কট্টর পর্ব এটি। ‘উদারতা’ শব্দ থাকায় তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, কিন্তু এ ‘উদারতা’ মানুষের জন্য কোনো উদার ব্যবস্থা নির্দেশ করে না। প্রকৃতপক্ষে এটি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত বিশ্বব্যবস্থার তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা নির্দেশ করে। ভেতর থেকে এটি চরম রক্ষণশীল। রক্ষণশীলতা ও এর বৃত্তাবদ্ধ চিন্তা কাঠামোর কারণে অনেকে এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘বাজার মৌলবাদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এ মতবাদের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিলটন ফ্রিডম্যান, রাজনীতিবিদদের মধ্যে রোনাল্ড রিগ্যান, মার্গারেট থ্যাচার আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইউএসএইড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর সুবিধাভোগী বিশ্বের একচেটিয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে দেশে দেশে দুর্নীতিবাজ-দখলদার ব্যক্তি-গোষ্ঠী। এর শিকার পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
এ সংবর্ধন প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে হয় না। কেননা পুরো প্রক্রিয়াটি অন্তর্গতভাবেই সহিংস। সংক্ষেপে বললে, কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে এ উন্নয়নধারা চিহ্নিত করা যায়। প্রথম বৈশিষ্ট্য— সর্বজনের সম্পদ ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া। সর্বজনের সম্পদ বলতে বোঝায় নদী-নালা, খাল-বিল, বন, পাহাড়, উন্মুুক্ত জমি, অর্থাৎ যার মালিক সবাই, যেখানে প্রবেশাধিকার সব মানুষের— যা ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হয় উন্নয়নের ধুয়া তুলে। দ্বিতীয়ত. সর্বজনের অধিকারের ক্ষেত্রগুলোকে ব্যক্তির মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করা। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষা ও চিকিত্সা। এসব বিষয় সর্বজনের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও ক্রমেই এগুলো পরিণত হচ্ছে উচ্চমুনাফা অর্জনে ব্যক্তিবিনিয়োগের ক্ষেত্রে। অধিকারের বদলে এগুলো পরিণত হচ্ছে ব্যয়বহুল মানহীন পণ্যে। তৃতীয়ত. অর্থনীতিসহ দেশের সব নীতিনির্ধারণী বিষয় কতিপয় দেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর কঠিন নিয়ন্ত্রণে রাখা। চতুর্থত. সর্বজনের সম্পদের ওপর পুঁজির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের ‘সহিংস’ বিভাগগুলোকে শক্তিশালী করা। ব্যক্তিমালিকানাধীন সন্ত্রাসী বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন, সন্ত্রাস, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট ও কর্তৃত্ববাদী তত্পরতা বৃদ্ধি পায়। পঞ্চমত. একই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, বৈষম্য ও চোরাই টাকার অনুপাত বৃদ্ধি। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্রমে দেশী-বিদেশী করপোরেট গোষ্ঠীর লাঠিয়ালে পরিণত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ‘উন্নয়ন’ যাত্রা এ মডেলেই পরিচালিত হচ্ছে (এ বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধে আরো বিস্তারিত আলোচনা আছে সর্বজনকথা, নভেম্বর ২০১৬ সংখ্যায়)।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিই। পার্বত্য চট্টগ্রামে ষাটের দশকে শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ উত্পাদনের এক ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প। মানুষকে কিছু না জানিয়ে, মানুষ ও প্রকৃতির কথা না ভেবে বিদেশী ঋণ নিয়ে কাজ শুরু হলো। এক রাতে এ প্রকল্পের ‘শুভ উদ্বোধনে’ গ্রাম-শহর ডুবে গেল, লাখো মানুষ ভেসে গেল। এভাবেই বৈরিতা আর সহিংসতার বীজ বপন ঘটল। এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। বাংলাদেশ একটুও বদলায়নি, তার ওপর ভর করেই এগিয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ধারার পরিবর্তন ঘটেনি।
চার দশক ধরে সহিংসতা, সামরিকীকরণ, জবরদস্তি, নির্যাতন, দখল, জাতিগত অস্তিত্বের অস্বীকৃতি ও অবমাননা— এসবই পার্বত্য চট্টগ্রামের দিনের পর দিনের কাহিনী। ‘উন্নয়নের’ ইতিহাস।
যে সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদ জোগান দেয়, যে সুন্দরবন প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে যা আমাদের সবার প্রাণ সমৃদ্ধ করে, যে বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন, যে বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি, বর্তমান সরকার তার বিনাশ করছে বিদ্যুৎ উত্পাদনের কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। আমরা সুই থেকে রকেট সবই তৈরি করতে পারব, কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্যে ভরা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। বিদ্যুৎ উত্পাদনের বহু বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবন ধ্বংসকে ‘উন্নয়ন’ বলে বন-জমি গ্রাসকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা চলছে।
একদিকে গ্যাসের সংকট বলে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প, দেশধ্বংসী রূপপুর প্রকল্প, মানুষ খুনের ওপর বাঁশখালী প্রকল্প করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা নষ্ট করে বিদেশী কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারের তত্পরতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। একদিকে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার জন্য জাতীয় সংস্থাকে দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ বিনা দরপত্রে জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তে বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা ও সুলভে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য বাংলাদেশের একটি বড় অবলম্বন। কিন্তু এমনভাবে চুক্তি করা হচ্ছে যে, এ গ্যাসসম্পদ বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিদ্যুতায়নের কোনো কাজে লাগবে না, উপরন্তু ভয়ঙ্কর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে আমরা ভয়াবহ সব খবর পাচ্ছি। একদিকে বিপুল ঋণনির্ভর এ প্রকল্পের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না কোম্পানি, অন্যদিকে এ প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে কোম্পানিকে পুরো দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ভারতীয় কোম্পানিকে। তাদেরও দেয়া হচ্ছে দায়মুক্তি। পুরো অস্বচ্ছতা, আর্থিক বোঝা ও ভয়ঙ্কর জাতীয় বিপদ তৈরি করতে করতে প্রকল্পের কাজ অগ্রসর হচ্ছে। জালিয়াতি করে জমি ক্রয় ও দখল করে দেশীয় এস আলম গ্রুপ ও চীনা কোম্পানির যৌথ প্রকল্প নেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। কোনো পরিবেশ সমীক্ষা না করে, জনগণের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করে এ ধরনের প্রকল্প শুরু করা বেআইনি। গত এপ্রিলে এ বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদ করায় শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনী গুলি করেছে, চারজন নিহত হয়েছে, বহুজন আহত। এ জালিয়াতির সমাধান ও হত্যাকাণ্ডের বিচার না করে গত ২৫ অক্টোবর বাঁশখালী প্রকল্প এলাকায় ‘নিরাপত্তার দায়িত্ব’ নিয়েছে যৌথ বাহিনী। বন্দুকের মুখে লাশের ওপর কোম্পানির মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহারের এটি একটি নমুনা।
গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি দখল করতে গিয়ে নির্বিচারে গুলি, গরিব মানুষের ঘরে ঘরে আগুন, নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী তত্পরতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিয়ে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ইত্যাদির অন্যতম লক্ষ্য ভূমি গ্রাস। বর্তমান উন্নয়ন মডেলে এটি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ বলে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি-বিদ্বেষ এর অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সহিংসতা আর প্রচ্ছন্ন থাকে না।
একই কারণে কারখানায় কারখানায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে গিয়ে একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হন শ্রমিকরা। নিজেদের মজুরি আর নিরাপত্তার কথা বললে রাষ্ট্রীয় বাহিনী খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক আশুলিয়ার ঘটনাগুলো এর সাক্ষী।
বাংলাদেশের প্রাণ এ দেশের নদ-নদী। অথচ বহু নদী মারা গেছে বা যাচ্ছে উন্নয়ন নামের বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেই। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা তার আরেকটি ফলাফল। বহু মানুষ যে নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে শহরে উদ্বাস্তু, তারও বড় কারণ এসব প্রকল্প। সরকার পরিবর্তনে এর ধারাবাহিকতার কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ এর সুবিধাভোগী অভিন্ন। এ দেশের নদী ও বনবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প, সড়ক-সেতু-ভবন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি, মানুষের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ভয়াবহ সব চুক্তি, ঋণনির্ভরতা সৃষ্টি, জাতীয় সক্ষমতার ক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নামের কনসালট্যান্ট ও আমলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে লাভবান হয় দেশ-বিদেশের কতিপয় গোষ্ঠী, তার মধ্যে বহু ‘বিশেষজ্ঞ’ও আছে, যারা এগুলোর কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না, কিন্তু ভোগান্তি বহন করতে হয় মানুষকে, প্রতিবাদ করলেও যাদের আঘাত পেতে হয়। উন্নয়ন নামের এসব প্রকল্পের যথেষ্ট বিরোধিতা হয়নি বলেই দেশে নদী, পাহাড়, জমি, জলাশয় এবং শেষ বিচারে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
মেগাপ্রকল্পে সরকারের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এসব প্রকল্পে নজরদারি বা জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে তার ব্যয়বৃদ্ধির কোনো সীমাও নেই। জরুরি কাজে অর্থের অভাব হলেও এসব প্রকল্পে বছরে বছরে ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশে সড়ক, সেতুসহ নানা নির্মাণকাজে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় এ কারণেই। লক্ষ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দুর্নীতি আর চোরাই তত্পরতার মধ্যে। দুর্নীতি আর অপচয় বাড়লে জিডিপির আকারও বাড়ে। উন্নয়নের পরিসংখ্যান ভালো দেখা যায়। সরাসরি সহিংসতা, জবরদখল আর আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে সর্বজনের বিপন্নতা তৈরি করে কতিপয় গোষ্ঠীর মূলধন সংবর্ধনের মডেলে কাজ করছে বাংলাদেশ, যা উপস্থাপিত হচ্ছে ‘উন্নয়ন’ নামে।
( 09 জানুয়ারী 2017 তারিখে দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত)