সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মেহেদী হাসান
প্রশ্ন: উইকিলিকস ও তার প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জের তথ্য ফাঁসের ঘটনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ: প্রযুক্তির বর্তমান স্তরে সাম্রাজ্যবাদী গোপনীয়তার দুর্গে যথোপযুক্ত হানা দেওয়ার একটি ধরন দেখিয়েছে উইকিলিকস। চক্রান্ত, গোপন ও প্রকাশ্য নেটওয়ার্ক এবং গোপন চুক্তি সমঝোতার মধ্য দিয়ে যে সাম্রাজ্যবাদী দানবীয় বিশ্বব্যবস্থা চলছে তাকে আরও উন্মোচন করার সম্ভাবনাকেও তা মানুষের সামনে উপস্থিত করেছে। উইকিলিকস বাড়তি কোন কাজ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের মধ্যে যে তথ্য বিনিময় হয়েছে, বিভিন্ন মার্কিন কূটনীতিক নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে যে রিপোর্ট করেছে সেগুলো প্রকাশ করেছে মাত্র। এর বাইরেও দানবীয় সাম্রাজ্যের আরো বহু কিছু আছে যা এসব রিপোর্টে নাই। যেমন: অলিখিত নানা সমঝোতা, চুক্তি, ঘুষ, হুমকি, চাপ, খুনসহ সহিংসতার নানা ঘটনা। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করে যেগুলো সাধারণভাবে প্রকাশ্যে মূলধারায় যুক্ত নয়, আপাতনিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়, থিংকট্যাংক, প্রচারমাধ্যম, বিনোদন সংস্থা এসবের অন্যতম। এর পরও উইকিলিকস যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশ উপলব্ধিতে অনেককে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে যারা চেনেন, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাদের কাছে এসব খবর নতুন কিছু নয়। কিস্তু এই বিশ্বে মিডিয়ার উপর একক কর্তৃত্বের মধ্য দিয়ে, গোলাম মিডিয়া, সাংবাদিকতা, সুশীল সমাজ ও থিংক ট্যাংক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হিংস্র চেহারার উপর যে আচ্ছাদন দেওয়া হয় তাতে খুনীকে মনে হয় উদ্ধারকর্তা; শয়তানকে মনে হয় ফেরেশতা; দুর্বৃত্তকে মনে হয় শান্তিসন্ধানী। আমরা দেখি, যুক্তরাষ্ট্র যখন বলে শান্তি, তখন আসে যুদ্ধ। যখন বলে উন্নয়ন, তখন আসে ধ্বংস। যখন বলে গণতন্ত্র, তখন আসে স্বৈরতন্ত্র।
হাইটেক সম্পর্কে একটি মায়াবী জাল তৈরী করে এরকম একটি ধারণা তৈরী করার চেষ্টা হয়েছিল যে হাইটেক যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার নিয়ন্ত্রণ সর্বব্যাপী করতে সক্ষম। সারা দুনিয়া তার হাতের মুঠোয় থাকবেই। তার বিরোধী কোন শক্তি পৃথিবীতে তাকে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। কিন্তু উইকিলিকস মানুষের শক্তির একটি ছোট নমুনা প্রকাশ করেছে যে, গোপনীয়তা আর বর্বরতার সাম্রাজ্য অবোধ্য নয়, অবধ্যও নয়। উচ্চ প্রযুক্তির সাম্রাজ্য বধ করার জন্য উচ্চ প্রযুক্তির মধ্যেই পাল্টা শক্তি গড়ে উঠছে। আরও উঠবে।
প্রশ্ন: বিভিন্ন দেশে দায়িত্বরত মার্কিন কূটনীতিকদের প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার গোপন বার্তা উইকিলিকস সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। এর ব্যাপকতা কতটা মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: এর প্রভাব সূদুরপ্রসারী। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসরদের পারস্পারিক সম্পর্কের জাল এর মধ্য দিয়ে অনেকখানি প্রকাশিত হয়েছে। তাদের পারস্পারিক গোপন প্রতিযোগিতা, ঘৃণা, অভিনয়, চক্রান্ত বর্তমান ভারসাম্যকেও বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তারা হয়তো এখন নতুন কৌশল গ্রহণ করবে। কিন্তু এই ঘটনা প্রান্তস্থ দেশগুলোসহ সারা বিশ্বের মানুষকে আরও সজাগ ও সতর্ক করবে, পাল্টা কৌশলে উদ্যোগী করবে । উইকিলিকস প্রকাশিত সকল তথ্য আমরা এখনও জানি না। তার নির্বাচিত কিছু অংশ নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান তাদের বিবেচনামতো প্রকাশ করেছে। এসব প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে গল্পের উপাদান না খুঁজে তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অনুসন্ধানটাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: প্রকাশিত এসব গোপন কূটনৈতিক বার্তার মধ্যে ঢাকা থেকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির কিছু স্পর্শকাতর বার্তা রয়েছে সেগুলো নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আনু মুহাম্মদ: ভাল। এসব বার্তায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো আমাদের অজানা নয়, কিন্তু সকলের কাছে এর কিছু উন্মোচন অনেককেই প্রকৃত বিষয় বুঝতে সহায়তা করবে।
প্রশ্ন: উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীর কয়লা তুলতে এবং কনোকো ফিলিপস এর সাথে গ্যাস চুক্তি করার জন্য মার্কিন কূটনীতিকদের ব্যাপক চাপ ছিল বলে উইকিলিসকের ফাঁস করা তথ্যে জানা গেছে। ফুলবাড়ী ও জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ: এসব আমরা কিছুটা জানি ও ধারণা করতে পারি বলেই জনগণের আন্দোলনের গুরুত্ব অনুভব করি। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছি যে, বাংলাদেশের জ্বালানী মন্ত্রণালয় কার্যত পরিচালিত হয় বহুজাতিক সংস্থার এবং তাদের লবিস্ট মার্কিনসহ বিভিন্ন দূতাবাস দ্বারা। সেকারণেই জাতীয় কমিটির সাত দফা দাবীর অন্যতম দাবী হচ্ছে, বাংলাদেশের জ্বালানী মন্ত্রণালয়কে বহুজাতিক কোম্পানি আর তাদের লবিস্টদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে। উইকিলিকস এর মাধ্যমে ফাঁসকৃত তথ্যে আমাদের এই এই বক্তব্যের যথার্থতাই প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, উন্মুক্ত খনির পক্ষে তৌফিক এলাহী চৌধুরী, সুবিদ আলি ভুইয়াসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী, বিভিন্ন কনসালটেন্ট ও কতিপয় সাংবাদিক যে ভূমিকা পালন করছেন তা একটি সাজানো জালের অংশ।
ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কনোকো ফিলিপসকে রপ্তানীমুখি চুক্তির মাধ্যমে সাগরের গ্যাসব্লক দেওয়া হবে। বলেছেন, জনগণের প্রতিরোধের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে উন্মুক্ত খনির পক্ষে জনমত গঠনে তারা আরও সচেষ্ট হবেন এবং পার্লামেন্টারি কমিটির মাধ্যমে তারা অগ্রসর হবেন। আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে অনেক বেশি দামে কমপ্রেশর কেনা সহ নানা সুবিধা প্রদানের কথাও দেয়া হয়েছে। সেই কাজগুলোই যে একান্ত বাধ্যগত কর্মচারীর মতো তারা করে যাচ্ছেন, গত কয়েক মাসের ঘটনাবলী থেকে তা স্পষ্ট। বাংলাদেশের গ্যাস সংকট সমাধানের জন্য সমুদ্রের গ্যাস চুক্তির কথা একদিকে প্রচার করা হচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানীর বিধান রেখে গ্যাস ব্লক তুলে দেওয়া হচ্ছে মার্কিন কোম্পানির হাতে। যে কোম্পানির হাতে এগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে সেটি এমন একটি কোম্পানি যেটি কিছুদিন আগে ভেনেজুয়েলা থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যে কোম্পানির প্রধান ব্যক্তি ইরাকে গণহত্যার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।
একদিকে কয়লা নীতি নিয়ে জনমত যাচাইয়ের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্মুক্ত খনির পক্ষে জনমত গঠনকে অন্যতম করণীয় হিসেবে নির্দেশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জ্বালানী খাত উন্নয়নের পথনক্সা তৈরি করেছেন। জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ কতিপয় সদস্য ও মন্ত্রী খুনি ও জালিয়াত এশিয়া এনার্জির আতিথ্যে জার্মানিতে আনন্দ ভ্রমণ করে এসে ঘোষণা করেছেন তারা উন্মুক্ত খনির পক্ষে। এরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জনগণের সর্বনাশ করে জনগণের গণরায়কে অগ্রাহ্য করে দেশে দীর্ঘমেয়াদী ধ্বংসযজ্ঞের পথ তৈরির জন্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির নির্লজ্জ ভৃত্যের দায়িত্ব পালন করছেন।
বহুজাতিক কোম্পানির লবিষ্ট হিসেবে মার্কিন দূতাবাসের এরকম ভূমিকা এটাই প্রথম নয়। এক দশক আগে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ মার্কিন কোম্পানি ইউনোক্যালের মাধ্যমে ভারতে রপ্তানীর জন্য তারা চাপ সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর মার্কিন একটি জালিয়াত কোম্পানিকে তুলে দেওয়ার জন্য মেরিএ্যান পিটার্স কয়েক বছর একটানা লবিং করেছেন। জনগণের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আমরা এইসব সর্বনাশা প্রকল্প ঠেকাতে সক্ষম হয়েছি। ফুলবাড়ীর মানুষ জীবন দিয়ে এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী থেকে বিতাড়ন করেছেন। কিন্তু সরকারের উপর ভর করে তাদের নখর, শৃঙ্খল এবং চক্রান্ত যে অব্যাহত আছে সেটিই উইকিলিকসের তথ্য থেকে বুঝা যাচ্ছে। সমপ্রতি লংমার্চের মধ্য দিয়ে জনগণের যে রায় প্রকাশিত হয়েছে সেটা নিয়ে তাদের উদ্বেগের খবরও পাওয়া গেছে। জনগণের এই ঐক্য ও প্রতিরোধ সামনে আরও শক্তিশালী হবে। দুর্বত্তরা পরাজিত হবে।
প্রশ্ন: উইকিলিকসের ফাঁস করা বাংলাদেশ বিষয়ক নথিতে বিতর্কিত বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে র্যাব সংশ্ল্লিষ্টতা ও তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সংশ্ল্লিষ্টতার তথ্য রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন-ব্য কি?
আনু মুহাম্মদ: যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে বড় সংগঠিত সন্ত্রাসী শক্তি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য খুনি বাহিনী তার পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে। তারপরও তল্পিবাহক প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের কারণে এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য এবং সহযোগী দেশ ও সংস্থাসমূহ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কার্যত বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার বিরোধী সমস্ত ধরনের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের সাথেই সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নানাধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে। সন্ত্রাস বিরোধিতা ও নিরাপত্তার নামে দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় এবং রাষ্ট্রবহির্ভূত বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরীতে তারা সবসময়ই সক্রিয়। যে দখল ও আধিপত্য তাদের লক্ষ্য, তা নিশ্চিত করবার জন্যই তারা অগণতান্ত্রিক শক্তি, গুপ্ত খুন ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সক্রিয়। তাই বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এর নামে যে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে তার দায় গত কয়েকটি সরকারের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উপরও বর্তায়।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের ‘ভারত ঘনিষ্ঠতা’ এবং সে ব্যাপারে ভারতের সতর্কতা রয়েছে বলেও উইকিলিস পরিবেশিত মার্কিন কূটনীতিকদের পাঠানো বার্তায় জানা যায়- বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আনু মুহাম্মদ: বর্তমান ভারত রাষ্ট্র ভারতের জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বর্তমান ভারত রাষ্ট্র হল একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজি, বর্ণবাদী, সামপ্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিনিধি। এই রাষ্ট্র অতএব যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কৌশল বাস-বায়নে ভারত এখন কেন্দ্র। এই অঞ্চলে বহুজাতিক পুঁজির সমপ্রসারণে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি প্রধান অবলম্বন। বর্তমান সরকারের সময় এর যে প্রকাশ দেখছি তা অতীতের ধারাবাহিকতা মাত্র।
চারদলীয় জোট সরকারের ‘ভারতবিরোধী’ পরিচয় ভারতের জন্য খুব সুবিধাজনক ছিল। তাদের সময়ও বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য ও বাজার সমপ্রসারণে কোন ছেদ পড়েনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার অতি উৎসাহের সঙ্গে ট্রানজিট, ঋণ চুক্তি, বন্দর, বিদ্যুৎ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, কাঁটাতারের বেড়া, বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার একদিকে চলছে অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, রেল, বন্দর, সংস্কৃতি, প্রচার মাধ্যম, বিজ্ঞাপন, পাঠ্যপুস্তক এগুলোর ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্যও বাড়ছে। এর স্থায়ীত্ব নিশ্চিতকরণেই তাদের সতর্কতা।
প্রশ্ন: দেশের সম্পদ, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশীদের সংশ্ল্লিষ্টতার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আনু মুহাম্মদ: ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক অনেক পুরনো। এই গোষ্ঠীগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের রিজার্ভ আর্মি হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধিতার নামে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাংলাদেশকে যে জালের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে তা দেশকে ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলছে। বঙ্গোপসাগরের আধিপত্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা আছে আবার চাপা সংঘাতও আছে। এছাড়া চীন, মায়ানমারেরও বঙ্গোপসাগরের ব্যাপারে নানা ধরণের আগ্রাসী পরিকল্পনা আছে। বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশে আধিপত্য নিয়ে এই শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য সমঝোতা বা সংঘাত যেটিই থাকুক না কেন সবগুলোই বাংলাদেশের জন্য বিপদজনক। বিপদজনক আরো এই কারণে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শাসক শ্রেণী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মেরুদণ্ডের প্রমাণ দিতে পারেনি।
প্রশ্ন: উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের পাঠানো নথির গোপনীয়তা নীতিকে কতটা প্রশ্নের সামনে ফেলেছে বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: গোপনীয়তা দুর্বৃত্তদের অন্যতম অস্ত্র। কারণ তারা জনগণকে ভয় পায়, জনমতকে ভয় পায়। এসব তথ্য থেকে এটি আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মতো দেশের সরকার এ দেশ পরিচালনা করে না। সরকার অধস্তন ভূমিকায় থাকে। নিজেদের গোষ্ঠীগত সুবিধা, ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য তারা দেশকে তুলে দেয় সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে। সরকারের, দেশি-বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোপনীয়তার বৃহৎ জালে বাংলাদেশের মানুষ বন্দি। নিরাপত্তার নামে গোপনীয়তা দিয়ে তারা শোষণ, লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করে। এই গোপনীয়তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে উইকিলিকসের মতো তৎপরতাও সমপ্রসারণ করতে হবে। এই অন্তর্ঘাত বস্তুত জনগণের প্রতিরোধের একটি উপায়।
প্রশ্ন: ফাঁস হওয়া এসব গোপন তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, শক্তির জোরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে এবং জাতিসংঘেও অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে তাতে এসব রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কর্ণধারদের সম্পর্কে কী ধারণা সৃষ্টি হয়?
আনু মুহাম্মদ: এটি স্পষ্ট হয় যে, এরা কর্ণধার নয়। এরা সুবিধাভোগী অধস্তন কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। জাতিসংঘ জাতিসমূহের স্বাধীন কোন সংঘ নয়। জাতিসংঘ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সমপ্রসারণ। আর বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কর্ণধার মানে জনগণের প্রতিনিধি নয়; নিপীড়ক লুটেরা শক্তির প্রতিনিধি, বহুজাতিক পুঁজির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক।
প্রশ্ন: উইকিলিকস ও অ্যাসাঞ্জের পথ ধরে ভবিষ্যতের তথ্য আন্দোলনের ধারা কি হতে পারে বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: উইকিলিকস যে সমস্ত তথ্য ফাঁস করেছে এসব তথ্য জানার অধিকার জনগণের শতভাগ আছে। বিশ্বে এবং বাংলাদেশে যদি স্বাধীন গণমাধ্যম থাকতো তাহলে তাদের দ্বারাই এসব তথ্য জনগণের জানার কথা। কিন্তু একদিকে দেখি প্রচার মাধ্যম বিস্তৃত হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির সুবিধা সমপ্রসারিত হচ্ছে অনেক; কিন্তু অন্যদিকে দেখি এই প্রচার মাধ্যম হাতে গোনা কিছু বহুজাতিক সংস্থা বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কব্জাগত। নিজেদের মূল ভূমিকা আড়াল করার জন্য যারা অপ্রয়োজনীয় গালগল্প বাজারজাত করার কাজেই ব্যস্ত থাকে। জনগণের জীবন ও সম্পদ লুণ্ঠন কিংবা জনগণের ভবিষ্যৎ বিপর্যস্ত করার বিভিন্ন আয়োজন সম্পর্কে এসব প্রচার মাধ্যম অধিকাংশ সময় শুধু নিরবই থাকে না, জনগণকে ভুল তথ্য দ্বারা প্রতারিতও করে; গণশত্রুদের জনগণের বন্ধু হিসেবে উপস্থিত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে এবং বিশ্বের সকল অঞ্চলেই বিকল্প প্রচার মাধ্যম তৈরি ও তাকে সমপ্রসারণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। শত্রুর দূর্গের মধ্যে থেকে জনবিরোধী সমস্ত চক্রান্ত ফাঁস করাও এই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ইন্টারনেটসহ বর্তমান উচ্চ প্রযুক্তি একদিকে যেমন গণশত্রুদের হাতে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে তেমনি বিশ্বব্যাপী জনগণের সামনেও স্বল্পব্যয়ে বৈশ্বিক প্রচার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। উইকিলিকস এর একটি নমুনা মাত্র।
(ডিসেম্বর ২৬, ২০১০ সাপ্তাহিক বুধবারে প্রকাশিত)