সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প নিয়ে ইউনেসকোর আপত্তি-অনাপত্তি নিয়ে বহুদিন থেকেই দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে। ইউনেসকো জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান, পুরো নাম জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা। ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে লন্ডন সম্মেলনে ইউনেসকো প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। আর এর একটি শাখা সংস্থা হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। এর দায়িত্ব নির্ধারিত হয় বিশ্বের সব দেশে যেসব প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো চিহ্নিত করা ও তার সংরক্ষণে বিশ্ববাসীর পক্ষে নজরদারি করা। ১৯৭৮ সালে এসব সম্পদের প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়। একপর্যায়ে বাংলাদেশের একমাত্র সুন্দরবন বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সেদিক থেকে ইউনেসকো, বিশেষত বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ওপর এর রক্ষণাবেক্ষণে নজরদারি করা একটা দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়।
শিক্ষা–সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিবিধ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইউনেসকোকে বেশ চাপ ও ধরাধরির মধ্যে কাজ করতে হয়। ১৯৪টি সদস্যরাষ্ট্রের চাঁদাতেই প্রতিষ্ঠান চলে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার এই প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেছে। ২০১১ সালে ফিলিস্তিনকে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চাঁদা দেওয়া শুধু বন্ধ করেনি, বৈরী ভূমিকাও গ্রহণ করেছে। যদিও মাত্র ১৪টি রাষ্ট্র এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়। ২০১৩ সালে চে গুয়েভারার জীবন ও কাজ ঐতিহ্যের অংশ করার উদ্যোগ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘদিনের বকেয়া শোধ না করে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই দুটি দেশ ইউনেসকো ত্যাগ করে। ইউনেসকোর ভূমিকা তাই নির্ভর করে তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অবস্থানের ওপর। বিভিন্ন কমিটিতে সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আসলে কাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে তাঁদের ওপর কারা কতটা প্রভাব বিস্তার করছে, তার ওপর।
৩০ জুন থেকে আজারবাইজানের বাকুতে ইউনেসকোর যে অধিবেশন হলো, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলও যোগ দিয়েছিল। তবে সুন্দরবন রক্ষার বিষয়ে বিশ্ববাসীকে জানাতে নয়, তারা গিয়েছিল এই বিশ্ব ঐতিহ্যবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য বিষাক্ত প্রকল্পের পক্ষে তদবির করতে, অসত্য ও ভুল তথ্য দিয়ে সেগুলোর বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টার নেতৃত্বে বড় একটি প্রতিনিধিদল একই উদ্দেশ্যে পোল্যান্ড গিয়েছিল। তাদের লবিং নিয়ে অনেক কাহিনিও তৈরি হয়েছে। অধিবেশন থেকে ফিরে তারা সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ‘ইউনেসকো রামপাল নিয়ে তার আপত্তি প্রত্যাহার করেছে।’ যেন ইউনেসকো আপত্তি প্রত্যাহার করলেই সুন্দরবন বিনাশ বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু এটা ছিল ডাহা মিথ্যা। সে বছর ইউনেসকোর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ১১টি সিদ্ধান্তের মধ্যে ৭ নম্বরে বলা হয়েছিল, ‘রামপাল প্রকল্প নিয়ে ২০১৬ সালে ইউনেসকোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশনের করা অন্যান্য সুপারিশও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’ ২০১৬ সালের মিশনের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ‘সুন্দরবনের অসাধারণ বিশ্বজনীন মূল্য (আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালু) আছে। তা রক্ষা করার জন্য রামপাল প্রকল্প বাতিল অথবা অন্যত্র স্থানান্তর করা হোক।’ এ ছাড়া ৪ নম্বর সিদ্ধান্তে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনো বৃহদাকার শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ না করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। এসব বিষয়ে অঙ্গীকার করে এলেও সরকার তার কিছুই রক্ষা করেনি, বরং এই সময়ে আরও দুই শতাধিক বিষাক্ত প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।
গত ২৯ জুন সংসদে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানিয়েছেন যে সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত এলাকার মধ্যেই, সুন্দরবন থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে, পরিবেশদূষণকারী বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এর কদিন আগে সুন্দরবন থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমতি দেওয়া হয়েছে এলপিজি প্লান্টসহ বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের। এগুলোর সবই সুন্দরবনের জন্য ভয়াবহ হুমকি।
কয়েক দিনের বিতর্ক, লবিং ও আলোচনা শেষে ৪ জুলাই বাকুতে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অধিবেশনে সুন্দরবন বিষয়ে কয়েক দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুন্দরবনকে বিপদাপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব স্থগিত রেখে, এর ৬ নং সিদ্ধান্তে ২০১৬ সালের মনিটরিং মিশনের উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রকল্প বিষয়ে বিশদ সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিতে বাংলাদেশ সরকারকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
সরকার দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য রামপাল প্রকল্প করছে বলে দাবি করে, এবারও ইউনেসকো অধিবেশনে করুণভাবে এটাই উপস্থাপন করেছে যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খুব দরকার। বাংলাদেশের পক্ষে লবিংয়ে যোগ দিয়েছেন ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা, যঁাদের বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো নদী ও পরিবেশবিনাশী হলেও তঁাদের লবিং কাজে দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের জন্যই
রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী প্রকল্প করা জরুরি, তা মোটেই সত্য নয়। দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও কতিপয় দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর বিপুল মুনাফা নিশ্চিত করা ছাড়া এই প্রকল্পগুলোর আর কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে এর চেয়ে অনেক কম ব্যয়বহুল, পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ পথ আছে, তা আমরা সরকারি মহাপরিকল্পনার বিকল্প রূপরেখায় পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছি।
কাদের জন্য সরকার এত লবিং, এত দৌড়াদৌড়ি, এত বিজ্ঞাপনী প্রচার করছে, এত গায়ের জোর দেখাচ্ছে? আসলে দেশ-বিদেশে এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সংখ্যা কম নয়। রামপাল প্রকল্পের জেরে আরও বহু বিষাক্ত প্রকল্প সরকারি অনুমোদন পাচ্ছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সুন্দরবন থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জমি বা বন দখল করে নিজেদের নামফলক টাঙিয়েছে। এই বৃহৎ বনদস্যু বা ভূমিদস্যুরা এলাকার সন্ত্রাসী ভাড়া করে সুন্দরবন আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাহারা বসিয়েছে। সরকারি প্রশাসন তো তাদের সঙ্গে আছেই।
রামপাল প্রকল্পে এনটিপিসির বড় ব্যবসার ব্যবস্থা হচ্ছে, ভারতের হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানি (ভেল) বড় কাজ পেয়েছে, সরকার তাদের নানা কাজে দেয় কর-শুল্ক মাফ করে দিয়েছে, শেয়ারবাজারে তাদের শেয়ারের দাম বেড়েছে, ভারতের এক্সিম ব্যাংকের বিশাল ঋণ ব্যবসা হচ্ছে, উদ্বৃত্ত কয়লার বাজার হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইএফসি এ প্রকল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। এ ছাড়া জার্মানির ফিশনার কোম্পানি এখানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছে। এর সব কটির সঙ্গে আছে দেশি লেজ, সাব-কন্ট্রাক্টর, কমিশনভোগী; যারা কিছু টাকার জন্য দেশ রসাতলে পাঠাতে দ্বিধা করে না। এদের সবারই দরকার গায়ের জোর। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার বাতিল বা উদ্বৃত্ত প্রযুক্তি ও কাঁচামাল গছিয়ে দিতে, তাদের আধিপত্য বাড়াতে গেলে স্বচ্ছ পথে হয় না, গায়ের জোরই লাগে। সরকার সেটাই তাদের উপহার দিচ্ছে।
ইউনেসকোর দায়িত্ব বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষা করা। কিন্তু সেই দায়িত্ব তারা কতটা পালন করতে পারবে, তা বলা যায় না। কারণ, বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করুণ বা অকার্যকর অবস্থা আমরা অনেক দেখছি। আসলে নিজের দেশের সম্পদ রক্ষার মূল দায় তো সরকারেরই থাকার কথা। জনমত, বিশেষজ্ঞ মত, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে সুন্দরবনের অতুলনীয় ভূমিকা—এগুলোর গুরুত্ব সরকারের কাছে থাকলে সরকার অনেক আগেই এ প্রকল্প বাদ দিয়ে সুন্দরবনকে আরও শক্তিশালী করায় মনোযোগ দিত। ইউনেসকোর মধ্যে গিয়ে লবিং, হাত কচলানো, বিজ্ঞাপনী প্রচার, অসত্য দলিলপত্র টানাটানি—কিছুই করতে হতো না। বরং সরকার বুক ফুলিয়ে বলতে পারত, আমরা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎও দেখতে সক্ষম; আমরা শুধু কিছু গোষ্ঠীর লোভ মেটাতে গিয়ে দেশকে অরক্ষিত করি না, দেশের ও বিশ্বের অসাধারণ সম্পদ নষ্ট করি না।
(১১ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)