আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এবং ‘রক্তমাখা হাত’

গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নের যে ধরন, নীতি ও কর্মসূচির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আর্জেন্টিনা তার চরম রূপ দেখেছে ৯০ দশকে। সেসময়ে উন্নয়নের নামে সেই দেশের সম্পদ দেশি বিদেশি ধনিক গোষ্ঠীর কাছে যে হারে বিক্রি হতে থাকে সেরকম দ্রুতহারে চিলিতেও ঘটেনি। কয়েক বছরের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ রাষ্ট্রীয় সম্পদ দেশের ধনিকগোষ্ঠী এবং বহুজাতিক সিটিব্যাংক, ব্যাংক বোস্টন, ফ্রান্সের সুয়েজ এবং ভিভেনদি, স্পেন এর বেপসল ও টেলিফেনিকার হাতে চলে যায়। এর আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লক্ষাধিক শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। কীভাবে হল এটা? মাত্র কয়েকবছরে আর্জেন্টিনার জাতীয় সম্পদের দ্রুত দখল কার্যক্রমের পরিকল্পনা কে প্রণয়ন করেছিল?

আজেন্টিনার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আলেহান্দ্রো ওলমস গাওনা এই সময় কালের সরকারী বিরাষ্ট্রীয়করণ কার্যক্রম নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এর জন্য বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি ১৪০০ পৃষ্ঠার একটি দলিল পান যা আর্জেন্টাইন সরকারের জন্য প্রণয়ন করেছিল বৃহৎ দুটি বহুজাতিক ব্যাংক – জেপি মরগান ও সিটি ব্যাংক। অর্থাৎ সেদেশের অর্থমন্ত্রণালয় নয়, মন্ত্রীসভা নয়, এমনকি আইএমএফও নয়, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি প্রণয়ন করেছিল দুটো বৃহৎ বহুজাতিক ব্যাংক! ইতিহাসবিদ গাওনা বলেছেন, ‘১৯৯২ থেকে আর্জেন্টিনার সরকার যা যা করেছে সব এই দলিলেই লেখা আছে। সব সেবামূলক খাত ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া। শ্রম আইন সংস্কার, পেনশন ব্যবস্থা বিরাষ্ট্রীয়করণ সবকিছু। – — – – তেল কোম্পানি, ফোন, এয়ারলাইন, ট্রেন, এয়ারপোর্ট, মহাসড়ক, পানি ব্যবস্থা, ব্যাংক, পোস্ট অফিস সবকিছু।’ ‘নির্বাচিত’ সরকার শুধু তা বাস্তবায়ন করে। আমদানী করা পণ্যে ছেয়ে যায় দেশ, দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। দারিদ্র সীমার নীচে জনসংখ্যাও দ্রুত বেড়ে যায়, দুই দশক আগে যেখানে তা ছিল শতকরা ২০ ভাগ তা ছাড়িয়ে যায় শতকরা ৫০ ভাগ।

আর্জেন্টিনার এসব কর্মসূচির বাস্তবায়নে আর্জেন্টিনার মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন তাকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র পথে অগ্রগতির একটি ‘সফল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইন্টার আমেরিকান ব্যাংকসহ তাদের সহযোগী প্রচার মাধ্যম। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টসহ সরকারী ব্যক্তিবর্গ সেসময় বলেছেন এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে অচিরেই আর্জেন্টিনা পরিণত হবে প্রথম বিশ্বভুক্ত একটি দেশে। আমরাও বাংলাদেশে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক বা তাদের পকেটে থাকা লোকজনের মুখে আর্জেন্টিনা বা চিলির মডেল নিয়ে উচ্ছাস শুনেছি। এসব প্রচারণা বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টিনার উন্নয়নের একটি ভ্রান্ত ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, কিন্তু বেশিদিন এই অবস্থা থাকেনি। তারা জৌলুসের ঢাকঢোল পিটিয়ে দারিদ্র ও বৈষম্য বৃদ্ধি ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে, পারেও অনেকখানি। কিন্তু অর্থনীতির অন্তর্গত সংকটের বহি:প্রকাশ হিসেবে যখন ব্যাংকসহ অর্থকরী খাতে বড় আকারের ধ্বস নামে তখন এসব প্রতিষ্ঠানের জারিজুরিও উন্মোচিত হয়ে পড়ে।

একই সময় পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশকে সাফল্যের অলৌকিক মডেল হিসেবে প্রচার করা হয়েছে সেখানেও নীতি সংস্কারের পরিণতিতে অর্থনৈতিক ধ্বস দেখা দেয়। কিন্তু এই সংকটকেও আগ্রাসনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণের চেষ্টা চলে। জন উইলিয়ামসন এসব নীতিমালার মূলভিত্তি ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ এর রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ সময় মৌলিকভাবে অর্থনীতিকে পাল্টে দেবার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ হাজির করে।’ এশীয় সংকটে দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যায়। ৬০০ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যায়। দাইয়ু, হুন্ডাই, স্যামসুং এবং এলজি বিভিন্নভাবে বহুজাতিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণে যায়। সামসুং কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ভলভো পায় এর ভারী শিল্প অংশ, জেনারেল ইলেকট্রিক পায় বিদ্যুৎ অংশ। জেনারেল মটরস ৬ বিলিয়ন মূল্যের দাইয়ূ ক্রয় করে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে। জেনারেল ইলেকট্রিক কেনে এলজি-র বৃহদাংশ। ২০ মাসের মধ্যে ১৮৬ টি বৃহৎ অঙ্গীভবন এবং আয়ত্তীকরণ ঘটে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন। মর্গান স্ট্যানলি এসব নানা লেনদেনে খুব কম সময়ে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

কিন্তু ভেনেজুয়েলাসহ ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে ৯০ দশকের সংকটে জনগণের মধ্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সমাবেশ দেখা যায়। আর্জেন্টিনাও ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতোই একদিকে পার করেছে কঠিন নিপীড়ন ও দারিদ্রের কাল, অন্যদিকে এক শক্ত জোয়াল থেকে মুক্ত হবার লড়াইও সেখানে দানা বেঁধেছে। নাওমী ক্লেইন তাঁর শক থেরাপী গ্রন্থে আর্জেন্টিনার তামাক চাষী এবং আর্জেন্টিনার এগ্রারিয়ান লীগের সেক্রেটারী জেনারেল সের্গিও তমাসেলার বক্তব্যের দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তমাসেলা স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যসহ বহুবছর বন্দী ও নির্যাতিত হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের মে মাসে তিনি ‘আর্জেন্টাইন ট্রাইব্যুনাল এগেইনস্ট ইমপিউনিটি’ তে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘রেখাটি ধারাবাহিক। যারা কয়েকশ বছর আগে এখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়েছিল তারা এখনও তাদের সামন্ত কাঠামোর মধ্যে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। . . . . . . . . বিদেশী একচেটিয়া কোম্পানীগুলো আমাদের উপর শস্য চাপিয়ে দিয়েছে, তারা চাপিয়ে দিয়েছে রাসায়নিক বিষ যা আমাদের ভূমিকে দূষিত করেছে, চাপিয়ে দিয়েছে তাদের সুবিধামত প্রযুক্তি ও মতাদর্শ। এসবই হয়েছে একটি ছোট গোষ্ঠীর মাধ্যমে যারা ভূমির মালিক এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই গোষ্ঠীও নিয়ন্ত্রিত হয় ঐ কতিপয় একচেটিয়া কোম্পানি দ্বারাই। এই কোম্পানিগুলো হল ফোর্ড মটরস, মনসান্টো, ফিলিপ মরিস। . . . . . আমি জানি সত্য ও ন্যায়ের বিজয় হবেই। বহু প্রজন্ম হয়তো লাগবে। এতে আমি মরে গেলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু একদিন আমরা জিতবই। এর মধ্যে আমি শত্রুকে চিনে নেবো যেমন শত্রুও আমাকে চেনে।’

২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারিতে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে গিয়ে ইভো মোরালেসও কয়েকশো বছরের লড়াইএর ধারাবাহিকতার কথা বলেন, ‘আমি তোমাদের বলতে চাই , এখানে সমবেত আদিবাসীদের বলতে চাই , আমাদের ৫০০ বছরের প্রতিরোধ আন্দোলন বৃথা যায়নি। এই গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আমাদের পূর্বসূরীদের সংগ্রাম; এটি উপনিবেশ বিরোধী আদিবাসী নেতা টুপার্ক কাটারি-র লড়াইএর ধারাবাহিকতা, এই সংগ্রাম চে গুয়েভারার লড়াইএর ধারাবাহিকতা।’

আর্জেন্টিনায় পুঁজির আগ্রাসী উন্মাদনার অবসান ঘটে ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর, যখন প্রেসিডেন্ট দুবা জনরোষের মুখে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন। কিন্তু তার আগে তার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ২১ জন বিক্ষোভকারী, আহত হন ১৩৫০ জন। বলিভিয়াতেও প্রেসিডেন্ট গণির সময়কালের শেষ পর্যায়ে প্রথম দেশব্যাপী বিক্ষোভ সৃষ্টি হয় পানি বিষয়ক একটি চুক্তি দিয়ে। বেখটেল এর সাথে সম্পাদিত এক চুক্তির কারণে পানির দাম শতকরা ৩০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। আইএমএফ এর নির্দেশে কর সম্প্রসারণের কারণে জনগনের উপর বোঝা বাড়ে। তারপরই বিক্ষোভ প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যখন যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাস রফতানির বন্দোবস্ত পাকা হয়। সারাদেশে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। সামরিক বাহিনী দিয়ে গণঅভ্যুত্থান মোকাবিলা করতে গেলে ৭০ জন নিহত হন, আহত হন অসংখ্য।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কিংবা দেশে দেশে সেনাবাহিনী যেগুলো বিশ্বপুঁজির দুর্গ হিসেবে কাজ করে সেগুলোতেও যে ফাটল সম্ভব তার বহু নজির এই ৯০ দশকেই সৃষ্টি হয়েছে। হুগো শ্যাভেজ নিজেই নির্যাতক সেনাবাহিনী থেকে বের হয়ে আসেন নতুন পরিচয় নিয়ে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করছিলেন জোসেফ স্টিগলিজ, তিনি এসব সংস্কারের নামে দুর্নীতি ও দখলের প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেন ১৯৯৯ সালে। তাঁরও আগে আইএমএফ থেকে পদত্যাগ করেন ডেভিসন বুধু নামে এক অর্থনীতিবিদ। গ্রানাডায় জন্মগ্রহণ করে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস এ পড়াশোনা করেন। ১২ বছর আইএমএফ এ কাজ করবার পর তিনি পদত্যাগ করেন। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও নিজ জন্মভূমি ক্যারিবীয় অঞ্চলের জন্য কাঠামোনীতি সমন্বয় কর্মসূচির ছক তৈরি ও বাস্তবায়ন ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব।

তিনি এই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবার সময় নিজ কর্মের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ভেতরের নানা অভিজ্ঞতা প্রকাশ শুরু করেন। পদত্যাগের পর আইএমএফ প্রধানের কাছে তিনি এক চিঠিতে লেখেন, ‘আজকে আমি আইএমএফ থেকে ১২ বছর পর পদত্যাগ করলাম, মাঠ পর্যায়ে ১০০০ দিন কাজ করার পর, তোমার দেয়া ওষুধ এবং চাতুরিভরা নানা কৌশল ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের কাছে ফেরী করার পর আমার এই পদত্যাগ। আমার কাছে এই পদত্যাগ হল অমূল্য এক স্বাধীনতা, এটি হল আমার হাত পরিষ্কার করার প্রথম ধাপ, যে হাতে আমার দিব্যচোখে আমি দেখি লক্ষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের রক্ত। এই রক্ত এতবেশি যে, তা দিয়ে নদী তৈরি হতে পারে। এটা শুকিয়েও চলে যায় না, দখল করে আমার পুরোটাকে; মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় তোমার নামে আমি যা করেছি তার ক্লেদ মুছে ফেলার মতো কোন সাবান এই দুনিয়ায় নেই।’ বলাইবাহুল্য, এই চিঠির খবর আন্তর্জাতিক কোন সংবাদমাধ্যমে ঠাঁই পায়নি।
সেইসব রক্তমাখা হাতের শৃঙ্খলেই বাংলাদেশ এখনো আটকে আছে।

(জানুয়ারি ২৬, ২০১২ bdnews24.com এ প্রকাশিত)