১৭ ফেব্রুয়ারি সরকার সংশোধিত ‘পিএসসি ২০১২’ অনুযায়ি ভারতের অয়েল এ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি বিদেশ) এবং অয়েল ইন্ডিয়ার সাথে বঙ্গোপসাগরের এসএস ৪ ও এসএস ৯ নামে চিহ্নিত ২টি গ্যাসব্লকের চুক্তি সম্পাদন করেছে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের এই দুটো ব্লকের প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার গ্যাস তেলসহ খনিজ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করলো। আগামী ৮ বছরে এই দুই ব্লকে অনুসন্ধান কাজে তারা মোট বিনিয়োগ করবে প্রায় ১৪ কোটি ডলার, টাকার অংকে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু সম্পদের শতকরা গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশের মালিকানা থাকবে তাদের। একই ধারায় এই মাসের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কনকো-ফিলিপসের সাথে ৭ নং গ্যাস ব্লক নিয়ে আরও ১টি চুক্তি করতে যাচ্ছে।
এর আগে পিএসসি ২০০৮ এ রফতানির বিধান নিয়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, জনপ্রতিরোধ ও জনমতের চাপে পিএসসি ২০১২ তে রফতানির বিধান রাখা হয়নি। এটি জনগণের আন্দোলনের বিজয় বলে আমরা মনে করি। কিন্তু সংশোধিত পিএসসি ২০১২-তে বিদেশি কোম্পানির অধিকতর মুনাফার স্বার্থে গ্যাসের ক্রয়মূল্য আগের চুক্তির তুলনায় শতকরা ৬০-৭০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর গ্যাসের দাম শতকরা ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, ব্যয় পরিশোধ পর্বে বিদেশি কোম্পানির অংশীদারিত্ব শতকরা ৫৫ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে শতকরা ৭০ ভাগ করা হয়েছে। চতুর্থত, ইচ্ছামত দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে, বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানী নিরাপত্তার প্রধান অবল¤¦ন। অথচ এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীন করে, বিদেশি কোম্পানিকে এত বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে যে, নিজ দেশের গ্যাস সম্পদ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপে পরিণত হবে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখিন হতে যাচ্ছে।
পুঁজির অভাবের কথা বলে এরকম চুক্তি করা হচ্ছে, অথচ এতে ওএনজিসি যে বিনিয়োগ করবে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে অলস পড়ে আছে। এইরকম মডেলে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ যে শুধু বিদেশি কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে তাই নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পায়নের জন্য গ্যাস সম্পদকে কাজে লাগানোও সম্ভব হবে না। আমদানি করা গ্যাসের চাইতেও বেশি খরচ হবে নিজ দেশের গ্যাস ক্রয়ে। উপরন্তু চুক্তির কারনে বাংলাদেশের আর্থিক বোঝাও সীমাহীন হবে। আমরা সরকারকে এই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের পরিবর্তে জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রয়োজনে সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানিয়েছি বারবার।
এসব চুক্তি করা হচ্ছে বাংলাদেশের সক্ষমতা নাই এই যুক্তি তুলে। কবে এই সক্ষমতা আসবে সে ব্যাপারে কি কোন কথা আছে? জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে সরকারের কি কোন উদ্যোগ আছে? নেই। ভারতের সক্ষমতা অর্জনে কতো বছর লেগেছিলো? প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ওএনজিসি সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছিলো। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও ‘আমরা পারবো না’ এটাই সরকারগুলোর সার্বক্ষণিক কথা। অক্ষমতার যুক্তি তুলে, দেশের ভবিষ্যৎ উজাড় করে, জনগণের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেবার আয়োজন হয়। তার বদলে কমিশন কিংবা ক্ষমতার নিশ্চয়তা। স্বাধীন মানুষের বদলে কমিশনভোগীরা দেশ চালালে কী হয় তাই দেখছে বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে। অবস্থা এরকম থাকলে সর্বনাশা চুক্তি হতেই থাকবে।
এই ধরনের পিএসসি প্রক্রিয়া সরকার নির্বিশেষে স্থলভাগ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেবার ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ। জনগণকে বঞ্চিত করে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দেশের সম্পদ উজাড় করে দেওয়ার এইসব আয়োজনের বিরুদ্ধে দেশবাসীর সক্রিয় প্রতিরোধ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।।
(ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১৪ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)