আমার মা

403543 288069101282482 1186815919 nচিত্রকরঃ অলকেশ ঘোষআমার মা যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স ১১ বছর। ১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর রাতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে অজ্ঞান হলেন, ঐ অজ্ঞান অবস্থাতেই তিনি পরদিন ২১ নভেম্বর দুপুরে মারা গেলেন, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে, পেছনে সাত সন্তান রেখে এবং আরেক সন্তান পেটে নিয়ে। আমি সাতজনের তৃতীয়, সর্বকনিষ্ঠজনের বয়স তখন দুইবছর। এরকম বিপদে কীরকম দোয়া পড়তে হয় তার কিছু শিখেছিলাম। কিন্তু সকাল থেকেই মাথায় কিছু কাজ করছিল না। শুধু আল্লাহ আল্লাহ আসছিল মুখে। রক্ত দেয়া হচ্ছিল ব্যাগের পর ব্যাগ। শুনলাম রক্ত শরীরে থাকছে না। আল্লাহর কাছে তো প্রত্যাশা কমে না। জানি তিনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন। ডাক্তার বসে আছেন, রক্তপাত বন্ধ হলেই অপারেশন করবেন। আমরা আবার ফেরত পাবো আম্মাকে, যেমন তিনি ছিলেন। আল্লাহ তো সবই পারেন। এতদিন দোয়া করেছি। শুনেছি ছোটদের দোয়া তিনি সবার আগে কবুল করেন। বেলা দুটোর সময় আম্মা যে ভবনে ছিলেন সেখান থেকে আব্বা উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলেন, আমরা দৌড়ে কাছে যেতেই বললেন, ‘সব শেষ’। তখনও বুঝিনি এর কঠিন মর্ম। ভেতরে গেলাম। হাসপাতালে সেই প্রথম দেখলাম আমার মাকে। এর আগে সেখানে ঢোকাই নিষেধ ছিল। গলা পর্যন্ত টকটকে লাল একটি কম্বল টানা। শান্ত, নিশ্চিন্ত, সৌম্য চেহারা নিয়ে আম্মা ঘুমিয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, মুখে প্রশান্তির ছাপ। এত যে কষ্ট গেল, এত যে ব্যথায় তিনি অজ্ঞান হলেন তার কোন ছাপ মুখে নেই। আমি তখনও হাল ছাড়িনি। কত অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছি, জানি আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের নানাভাবে পরীক্ষা করেন। তিনি তো যা খুশি তাই করতে পারেন। জীবন নিতে পারেন, দিতেও পারেন। কতজনের এরকম ঘটনা শুনেছি। সবাই কাঁদে, আমি সেই পথ খুঁজি। আল্লাহর সাথে তাই তখনও আমার কথা চলছে, একতরফা।

পাগলের মতো আরজি করতে থাকলাম রাতে। আমি বুঝতে পারছি সময় শেষ হয়ে আসছে, সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাত তখন প্রায় ১১টা। সেসময় আমি ট্রাকে, পেছনে খোলা জায়গায়। প্রথামতো সবকিছু করে আম্মাকে তখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আজিমপুর গোরস্তানের দিকে। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা আম্মার খাটিয়ার পাশেই আমি দাঁড়ানো। সেদিন রাতে আকাশ একদম পরিষ্কার ছিল, অসংখ্য অসংখ্য তারা সে রাতে। ঝকঝক করছে আকাশ। আমি সেই ঝকঝকে আকাশ আর অসংখ্য তারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে অবিরাম দোয়া পড়ছিলাম। আমি তখন জানি আল্লাহ ঐ আকাশেরই কোথাও থাকেন। আম্মাও মারা গিয়ে ঐখানেই যাবার কথা। আমার অস্থিরতা সমানে বাড়ছিল, কারণ এতটুকু আমি তখন নিশ্চিত যে আম্মাকে ফেরত পাবার সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আল্লাহর কাছে আমার আরজি তখন একটাই, ‘এখনও সময় আছে আল্লাহ আম্মাকে বাঁচিয়ে দাও, এর পরিবর্তে না হয় আমাকে নিয়ে যাও।’ ট্রাক চলছে। বড় বড় গাছ তখন ঢাকা শহরে। তার ফাঁকে ফাঁকে আমি দেখি তারা ভরা আকাশ। ভেতরে অনর্গল কথা চলছে। সবাই দোয়া পড়ছে মৃতের মাগফেরাতের জন্য। কিন্তু আমি তো চাই মৃত্যুর ঘটনাটাই পাল্টে দিতে। আমি যা চাইছি তার দোয়া জানি না, তাই আমার প্রার্থনা সরাসরি আল্লাহর দরবারে। তাও বাংলায়। জানি, কবর হয়ে গেলে আর সুযোগ থাকবে না। আমার অস্থিরতা তখন তাই সীমাহীন।