আমরা কেন কর দেব?

সবাই এখন জানেন ২০১৪-১৫ অর্থবছর বা জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালে সরকার কীভাবে আয় করবে, কী কী তার অগ্রাধিকার এবং কীভাবে তার ব্যয় হবে তার সরকারি ভাষ্য। এটাই বাজেট নামে পরিচিত। এই অর্থবছরের বাজেট স্বাভাবিক নিয়মে আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক বড়। আমাদের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) মানে এক বছরে সারা দেশে উৎপাদন ও পরিসেবার মোট মূল্য। হিসাবের বিদ্যমান বিন্যাসের কারণে জিডিপিতে বাংলাদেশের সব অর্থনৈতিক তৎপরতা অন্তর্ভুক্ত হয় না। বৈধ-অবৈধ সব অর্থনৈতিক লেনদেন ও তৎপরতা অন্তর্ভুক্ত হলে জিডিপি আরও বেশি হবে।

অর্থনীতির আকারের তুলনায় টাকার অঙ্কে তাই বাজেট মোটেই বড় নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পর্যায়ে উন্নয়ন গতির যে তাগিদ সেই তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দও অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বড়, বলা যাবে না। জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও অর্থনীতির গতি অনুযায়ী অস্বাভাবিক নয়।

প্রচলিত বাজেট আলোচনার একটা বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে- এই পরিসংখ্যানগুলো নিয়েই আটকে থাকা। আলোচনায় সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যানের গতি-প্রকৃতি, তার গুণগত দিক খুব কমই আসে। বাজেট মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব নয়। কোথা থেকে সরকার আয় করে, কোথায় সরকার তা ব্যয় করে তা নির্ভর করে সরকারের উন্নয়ন দর্শনের ওপর, সামাজিক কোন শক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে সরকার তার প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। আয়-ব্যয় ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্ট হয়। সে জন্য বাজেট বিশ্লেষণে বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্লেষণ যেমন দরকার, পাশাপাশি দরকার এর গুণগত বিশ্লেষণ। বরাদ্দ মানেই তা জনস্বার্থে ব্যয় হচ্ছে- এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

গত কবছরে সরকার সফলভাবে জনগণের ওপর করজাল বিস্তৃত করেছে। পাঁচ বছরে কর থেকে আয় তিনগুণ বাড়াতে পেরেছে। এ বছরও ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণের ওপর বোঝা বাড়িয়েছে। তার পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি বাজেটে বেশ বড় আকারের ঘাটতি। ঋণের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা। সেজন্য এই বছর রাজস্ব বা অনুন্নয়ন বাজেট বিবেচনা করলে ঋণের সুদ হিসাবে তা সর্বোচ্চ।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসহ শিক্ষা খাতে বাজেট ২৮ হাজার কোটি টাকা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১১ হাজার কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা আর ঋণের সুদ বাবদ খরচ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদের এই বোঝা তৈরি হয়েছে অতীতের ঋণের জন্য। এই বছরও ঋণের ওপর যে নির্ভরশীলতা দেখা যায়, তাতে ভবিষ্যতে সুদের পরিমাণ আরও বাড়বে এতে কোনও সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রীয় বাজেটে ঋণ কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু ঋণের টাকা কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এই টাকা উৎপাদনশীল খাতের সম্প্রসারণ ঘটাবে, না বোঝা তৈরি করবে। এই সরকারের আগের মেয়াদে পাঁচ বছর যে নীতি-কাঠামো দিয়ে সরকার পরিচালিত হয়েছে, তাতে বিভিন্ন স্তরে উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি ও অপচয়ের স্বার রেখেছে। কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে ঋণনির্ভর করা হয়েছে। তার পরও মানুষ এখন ৫ বছর আগের তুলনায় তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। সেগুলোর ধারাবাহিকতায় ক্রমান্বয়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে। আর ঋণের সুদের বোঝা টানতে জনগণের ওপর আরও করের বোঝা চাপানো হয়েছে।

এবারের বাজেটে ভ্যাটের সম্প্রসারণ ঘটানোর ফলে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। উপরন্তু শুল্ক-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। কিছুদিন আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সামনে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে কোনও বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ যতটুকু দেওয়া হচ্ছে তার সিংহভাগ ভুলনীতির কারণে অপচয় ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছে, হবে।

প্রাথমিক শিক্ষাসহ শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ আগের ধারাবাহিকতায় জিডিপির শতকরা দুই ভাগের মধ্যে আটকে আছে। শিক্ষাকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সে অনুযায়ী বাজেট পুনর্বিন্যাসের কোনও লক্ষণ এই বাজেটেও নেই। শিক্ষা খাতে ব্যয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সীমা হচ্ছে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ এখনও তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয় করছে। ফলে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ স্কুলেই ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। গত কয়েক দশকে সরকার নির্বিশেষে এই ধারাবাহিক ভূমিকার কারণে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটছে। কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউশনি, গাইড বইয়ের বাণিজ্য গ্রাস করছে শিক্ষা খাতকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন ভয়াবহ তৎপরতা বিপর্যস্ত করছে এই খাতকে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। স্বাস্থ্য খাতে নিম্নমানের বরাদ্দ দিয়ে পাবলিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যয়বহুল চিকিৎসা সম্প্রসারণের পথ তৈরি হয়েছে। কৃষি ও পাট বাংলাদেশের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ধারণ করে। এই দুটি ক্ষেত্রেই এবার বরাদ্দ অনেক কম। অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন- সরকার কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় অনেক ভুল তথ্য ও বাগাড়ম্বরের এটি একটি দৃষ্টান্ত। বাজেট বক্তৃতায় অনেক ‘করা হয়েছে’, ‘করা হবে’ বলা হয়েছে, অনেক কথার ফুলঝুরি আছে, আছে অনেক অতিরঞ্জন। আবার অনেক সত্য আড়াল করা হয়েছে।

বাংলাদেশে চোরাই অর্থনীতির বিপুল সম্প্রসারণ হয়েছে গত এক দশকে। যারা এই বিপুল সম্পত্তির মালিক, তারা এখনও কর কাঠামোর বাইরে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই এই চোরাই অর্থনীতি জিডিপির কমপক্ষে ৪২ ভাগ, তা শতকরা ৮৩ ভাগ হতে পারে। শতকরা ৫০ ভাগ ধরলেও এর পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি, বর্তমান বাজেটের দুই গুণের বেশি। এই চোরাই অর্থনীতির যারা মাথা তারাই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের তৎপরতায়ই সমাজে সন্ত্রাস, দখল ও লুণ্ঠনের ঘটনা বাড়ছে। দুর্নীতির যে জাল তৈরি হয়েছে তা ক্রমান্বয়ে আরও সম্প্রসারিত হয়ে জনগণের ওপর চেপে বসেছে। বাজেট নীতির মাধ্যমে সরকার তার রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগ আদায় করছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু বরাদ্দে স্বচ্ছতার অভাব, বিভিন্ন প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়নে সীমাহীন দুর্নীতি, পরিবেশ দূষণসহ দখল লুণ্ঠনের প্রতি সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জনগণের করের টাকা ও তাদের নামে নেওয়া ঋণের টাকার বড় অংশ চলে যাচ্ছে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। এই চোরাই অর্থনীতির দিকপাল বিপুল সম্পত্তির মালিকদের আয়ের বড় অংশ কর কাঠামোর বাইরে। এদের করজালের মধ্যে না এনে সব বোঝা চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।

কৃষকরা দেশের মানুষের খাদ্যশস্য সরবরাহ করছেন, গার্মেন্ট শ্রমিকরা প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন, প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠাচ্ছেন ১৫ বিলিয়ন ডলার। জনগণের বিপুল অংশ কর দিয়ে সরকার চালাচ্ছেন। মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের শান-শওকতের প্রতিটি অর্থ প্রকৃতপক্ষে জনগণের রক্ত-ঘাম থেকে আসে। জনগণ কর দিচ্ছে তাদের নিরাপত্তার জন্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য, জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য, উৎপাদনশীল খাতে সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। আর তার পরও তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন, তাদের কাজ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান হচ্ছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে জনগণের অর্থে প্রতিপালিত পুলিশ-র‌্যাব আটক-বাণিজ্য করছে, ক্রসফায়ার-বাণিজ্য করছে, অন্যের ভাড়া খেটে খুন করছে। সন্ত্রাস ও সহিংসতায় নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রণীত নীতি ও প্রকল্প খেয়ে ফেলছে জনগণের অর্থ। আর সেই লুটেরা দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই ব্যবহৃত হচ্ছে প্রশাসন, আইন।

সে জন্য এখন করের বিনিময়ে জনগণ কী পাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে সেই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। জনগণ তার যা দেওয়ার তা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সরকারের যা দেওয়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে সীমাহীন ব্যর্থতা। জনগণের মধ্য থেকে তাই জোর প্রশ্ন তুলতে হবে, আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, পাট, রেলওয়ে, আমাদের জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে যদি অর্থ ব্যয় না হয় তাহলে আমরা কর দেব কেন?

(June 11, 2014 ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)