আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয় না

[গণবিরোধী যেকোনো চক্রান্তের বিপক্ষে সরব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তাঁর জীবন ও সংগ্রামের গল্প শুনেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান।  সাক্ষাতকার গ্রহণঃ ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশঃ ৮ জানুয়ারি ২০১৫, কালের কন্ঠ]
040952kkkkkkkkk1কোথায় জন্মেছিলেন?
জন্ম জামালপুরে, নানাবাড়ির উঠানের আঁতুড়ঘরে। জন্মের দু-তিন বছর পর থেকে ঢাকায় বসবাস। বাবা (মোহাম্মদ আজগর আলী) তখন কলেজ শিক্ষক। প্রথম বাসা ছিল কমলাপুর। রেলওয়ে স্টেশন হওয়ার পর খিলগাঁওয়ে চলে আসি। তার পর থেকে এখানেই। প্রথম স্কুল সিদ্ধেশ্বরী। হেঁটে হেঁটে যেতাম। ফাইভে পরীক্ষা দেওয়ার পর বাসার কাছে খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সিক্সে ভর্তি হলাম। ওই বছরই ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার সময় মা (বেগম হাফিজা) মারা গেলেন। আমার বয়স তখন ১১। আমরা তখন সাত ভাইবোন ছিলাম। সবার ছোট বোনের বয়স তখন দুই বছর। কয়েক বছর পর ছোট মা আসেন। এখন আমরা ১১ ভাইবোন।  

তারপর?
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তির খবর শুনে আব্বা আমাকে আগ্রহ নিয়ে পরীক্ষায় বসালেন। একে তখন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্কুল বিবেচনা করা হতো। আব্বার ইচ্ছা আমি ওখানে পড়ি। ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হলাম। খিলগাঁও থেকে ল্যাবরেটরি স্কুল অনেক দূর। একা একা বাসে চড়ে যেতাম। যেহেতু আম্মা নেই, ছন্নছাড়া ভাব এসে গেল। অনেক সময় লেট হতো। অনেক সময় এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করতাম। কোথায় যাই, আরেক বাসে উঠি, এই করি, সেই করি। নাইনে গিয়ে স্কুলের খাতা থেকে নামও কাটা গেল।

কোথায় ভর্তি হলেন?
কলেজিয়েট স্কুলে। ওটাও অনেক দূর, সেই সদরঘাট। বাসে যেতাম। ওখানেও খুব নিয়মিত ছিলাম না। ওখানে একটি বড় আন্দোলন হয়েছিল। ‘পাকিস্তান : কৃষ্টি ও সংস্কৃতি’ নামের পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে খুব মহিমান্বিত করে লেখা একটি বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেটির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন। তখন তো অত বুঝি না; মিছিলে গিয়েছিলাম।  

লেখালেখির সূচনা?
একাত্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে মানসিক বয়স অনেক বেড়ে গেল। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, নিপীড়ন, শোষণ, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ—এসব বিষয়ে হয়তো ওই বয়সে মনোযোগই আসত না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে এদিকে আগ্রহ বাড়ল, স্বাধীনতার পর এগুলো নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। আর আগে থেকেই পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাকে ছোটদের পাতায় লিখতাম। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা, বিচিত্রায় লেখা পাঠাতে লাগলাম। বাহাত্তর সাল থেকে বিচিত্রায় নিয়মিত লিখি। তিয়াত্তরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। ক্লাস বেশি করা হতো না। সাইকেল ছিল, খুব ঘুরতাম। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ছাড়াও নানা লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়েছি। বইয়ের ব্যাপারে বরাবরই খুব আগ্রহ ছিল। বইপত্র পড়তাম, সেমিনারে যেতাম, রাজনৈতিক দলের অফিসে যেতাম। খোঁজখবর নিতাম—কিভাবে দেশের পরিবর্তন হবে, বিপ্লবী আন্দোলন কিভাবে তৈরি করা যাবে? ভিয়েতনাম তখন আমাদের বড় একটি শক্তির জায়গা। সে দেশে লড়াই হচ্ছে। আরো বিভিন্ন দেশের কাহিনী শুনি, পড়ি। বিচিত্রায় রেগুলার লিখি। লিখলাম ‘একটি গ্রাম, লক্ষ গ্রাম’। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিচিত্রায় সিরিজ লিখলাম। সাইকেল নিয়ে তখন সারা ঢাকা ঘুরেছি। দেখেছি, অনেক লঙ্গরখানা, বিভিন্ন জায়গায় লাশ পড়ে আছে, মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে বা আধমরা পড়ে আছে, পুরো পরিবার দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত। এ ধরনের অনেক পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের কথা নিয়ে সিরিজ লিখেছি—‘আপনারা কেমন আছেন?’ পঁচাত্তরের মে মাসের দিকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম। বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন, সামরিক বাহিনী, চক্রান্ত—এসব বিষয়ে তখন অনেক মনোযোগ। বিচিত্রায় থাকায় কিছু খোঁজখবরও জানি। মনে আছে, ১৫ আগস্টের আগের রাতে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বই, জার্নাল অবলম্বনে বিভিন্ন দেশে সিআইএ কিভাবে কাজ করে—এমন একটা লেখা তৈরি করছিলাম। সকালে উঠে খবর শুনে তাই মনে হলো, বাংলাদেশও এ রকম চক্রান্তের মধ্যে ঢুকে গেল।  

জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তির গল্পটি শুনব।
আম্মার আগ্রহ ছিল ডাক্তার হব। তাই সায়েন্সে পড়েছি। ইন্টারমিডিয়েটেও সায়েন্স ছিল। অপশনাল বায়োলজি। কিন্তু তত দিনে আগ্রহ সমাজবিজ্ঞানের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকেছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি চলছে, পড়াশোনা করছি। মেডিক্যালে ভর্তির আগ্রহও কমে গেছে। তার পরও পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম। ভর্তি হওয়ার আগে পরিস্থিতি দেখার জন্য মেডিক্যালে গিয়ে পছন্দ হলো না। মনে হলো, কাটাকাটি, ওষুধপত্র, লাশ—এসব নিয়ে টিকতে পারব না। সিদ্ধান্ত নিলাম, ভর্তি হব না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি শেষ। কিছুদিন পর জাহাঙ্গীরনগরে নোটিশ দিল, সিট খালি আছে। দ্বিতীয় দফা ভর্তি হলাম (হাসি)। অর্থনীতিতে ভর্তি হব এমন চিন্তাই ছিল না, কিন্তু দেখলাম যে কয়টা ডিপার্টমেন্ট আছে, তার মধ্যে অর্থনীতিতেই ভর্তি হওয়া যায়। নিজে নিজে খুঁজে খুঁজে এসে তখন এখানে ভর্তি হলাম। ছিয়াত্তরে ক্লাস শুরু হলো। মীর মশাররফ হোসেন হলে উঠলাম। পরে আল বেরুনী এক্সটেনশনে চলে এলাম। আমরা এই হলের নাম দিয়েছিলাম ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছাত্রাবাস’।  

হুমায়ুন ফরীদি আপনার বন্ধু ছিলেন।
ক্যাম্পাসে আসার পরই যার সঙ্গে প্রথম ও স্থায়ী বন্ধুত্ব, সে হলো এই ফরীদি। এমনিতে সে আমার চেয়ে বড় ছিল। কয়েক বছর গ্যাপ দিয়ে আবার অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছিল। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমার হল পরিবর্তনেরও সে বড় কারণ। ওর আগ্রহেই এক্সটেনশনে চলে এলাম। ফরীদির বাসায় গেছি, ওর পরিবারের সঙ্গেও অনেক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। পরীক্ষার সময় তো একসঙ্গেই পড়তাম। আমাদের চারজনের একটা গ্রুপ ছিল। আমি, ফরীদি, বাকি দুজনের একজন রুমমেট—ভূগোলের অধ্যাপক মঞ্জুরুল হক, আরেকজন কবি ফজল মাহমুদ—একটু বেশি আবেগপ্রবণ ছিল। প্রেমসংক্রান্ত জটিলতায় ও আত্মহত্যা করে।  

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেমন কেটেছে?
এই বন্ধুরাসহ অনেকে মিলে পত্রিকা বের করা, স্টাডি সার্কেল করা, লাইব্রেরি করা—এমন অনেক কার্যক্রম করেছি। এগুলো ক্যাম্পাসে আমার বড় আনন্দের জায়গা ছিল। নিয়মিত তখন বিচিত্রায় যেতাম। অনেক লেখা লিখেছি। বিচিত্রায় প্রচ্ছদ কাহিনী অনেক বেশি সিরিয়াস, ইনভেস্টিগেটিভ ছিল। কোনো কোনো মাসে দুটি-তিনটি প্রচ্ছদ কাহিনী লিখতাম। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত খুব সক্রিয়ভাবেই বিচিত্রায় লেখালেখি করেছি। ঢাকার বাইরেও গেছি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন প্রধানত বিচিত্রাকেন্দ্রিক। পাশাপাশি পড়াশোনা চলত। পরীক্ষার আগে বিচিত্রা থেকে ছুটি নিয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতাম। ফল খারাপ হয়নি, অনার্স-মাস্টার্স দুটিতেই ফার্স্ট হয়েছিলাম। পেশাগতভাবে শিক্ষকতা ছাড়া যে আমার করার কিছু নেই সেটা বুঝেছিলাম। অন্য পেশায় মানিয়ে নিতেও পারব না। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে বছরখানেক দেরি হলো। তখন বিআইডিএসে (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ) গবেষণার কাজ নিলাম। বিষয় ছিল ‘পিজেন্ট ডিফারেনশিয়েশন’। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছি। ১৯৮২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এখানে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম।  

শিক্ষক হিসেবে আপনি তো খুব জনপ্রিয়।
শিক্ষকতা আমার আগ্রহ এবং আনন্দের জায়গা; দায়িত্বেরও বটে। আসলে শিক্ষকতায় আনন্দ পেতে চাই। একটি ক্লাস মানে অনেক ছাত্রছাত্রী; তারা প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে, তাদের অভিভাবকরাও অপেক্ষা করছেন। সুতরাং কোনোভাবেই যেন তাদের সময় নষ্ট না হয়, কখনোই ভুলি না। শিক্ষকতার আরো একটি বড় জায়গা হচ্ছে, এ তো কেবল চাকরি নয় যে ফাইলপত্র সই করতে হবে; নিজের মানসিক তাগিদ না থাকলে এই কাজ হয় না। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হয়, শিক্ষকতার মধ্যে আনন্দ পেতে হয়। একদিক থেকে প্রতিটি ক্লাস হলো একেকটি পরীক্ষা। কেউ যদি পড়তে আনন্দ না পান, পড়াতে আনন্দ না পান, তাঁর জন্য শিক্ষকতা খুব কঠিন। ফলে তিনি ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি হতে ভয় পান, তখনই ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্ব তৈরি হয়। এটি শিক্ষকের নিরাপত্তাহীনতা থেকে ঘটে। নিজে দক্ষ না হলে এই দূরত্ব তৈরি করে শিক্ষক নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।  

শিক্ষকতার পাশাপাশি আর কী করেছেন?
সাংস্কৃতিক সংগঠন লেখক শিবির, কৃষক ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন—এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৮১ সাল থেকে বদরুদ্দিন উমর সম্পাদিত ‘সংস্কৃতি’ আবার প্রকাশ শুরু হয়। সেটির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। আশির দশক আমার সাংগঠনিক দশক। শিক্ষকতার পাশাপাশি ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকার সম্পাদনা, চার দফা লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদকসহ আরো দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশে অনেক ট্যুর করতে হতো, পাশাপাশি লেখালেখি। ১৯৮৬-৮৭ এ দুই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ১৯৮৭ সালে নূর হোসেন হত্যার পর আন্দোলন যখন একেবারে গণ-অভ্যুথানের আকার ধারণ করে, তখন তো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করল। জরুরি অবস্থা ভেঙে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা মিছিল বের করেছিলাম। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সঙ্গেও কাজ করেছি।  

লেখক শিবিরের জীবন কেমন কেটেছে?
১৯৮৪ সালে লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হই। বদরুদ্দিন উমর, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমেদ—এসব গুণী ব্যক্তির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। ১৯৮৪ সালেই লেখক শিবিরের সদস্যপদ গ্রহণের জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মনে হলো, তিনি এর জন্য অপেক্ষাই করছিলেন। লেখক-শিল্পী হিসেবে তাঁর যে মান, সেটি অনেক উঁচু তো বটেই, মানুষ হিসেবেও তিনি অতুলনীয়। ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে অনেক সফরে গেছি। তাঁর সঙ্গে সফর, আড্ডা ছিল আনন্দময়, সমৃদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা। হাসান আজিজুল হক খুব প্রাণবন্ত মানুষ। তাঁদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সম্মিলন ঘটেছিল। ইলিয়াস ভাইয়ের মধ্যে সিরিয়াসনেস ও রসবোধ দুটিই প্রবল ছিল। তাঁকে খুবই প্রাণবন্ত সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। ১৯৮৪ সাল থেকে তাঁর মৃত্যু (১৯৯৭) পর্যন্ত সাংগঠনিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রামের, অসাধারণ মানুষ। ১৯৯১ সালে যখন উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলো, তাঁর সঙ্গে আমরা সে এলাকায় গেছি। ইলিয়াস ভাইয়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর বিভিন্ন কারণে লেখক শিবিরের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে আর যোগাযোগ থাকল না।  

পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি নিয়ে ভূমিকা রেখেছেন।
নব্বইয়ের দশকে এসে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হলো। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে লোগাঙ হত্যাকাণ্ড হয়। হত্যাকাণ্ডের সূত্রে ১৯৯২ সালে ইলিয়াস ভাইসহ অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে আমরা দেখলাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সেটির ব্যাপারে বাঙালিদের ভূমিকা পালন করা উচিত। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি করলাম। এটিই প্রথম উদ্যোগ, যেখানে পাহাড়ি-বাঙালি সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়নবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। আমরা কিছু দাবিদাওয়া উত্থাপন করলাম। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। বাঙালিদের যে নীরবতা, তা ভাঙার ক্ষেত্রে এই কমিটি ভূমিকা রেখেছে। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ি-বাঙালির ঐক্য আর রাখা গেল না। পাহাড়িদের এক অংশ শান্তিচুক্তির পক্ষে, আরেক অংশ বিপক্ষে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বস্তি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, ওসমানী উদ্যান রক্ষা কমিটি, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি কমিটির মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। টানবাজারের পতিতাদের ওপর দখলদারদের আক্রমণ হলে তাঁদের সঙ্গে আমরাও সভা-সমাবেশ করেছি। ওই সময়ই অনলাইন পত্রিকা ‘মেঘবার্তা’ সম্পাদনা শুরু করি।  

ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও তো আপনার প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক ভূমিকা আছে।
১৯৯৮ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবেই যুক্ত ছিলাম। এই আন্দোলনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ। তাদের কারণেই ধর্ষণবিরোধী, যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য জাহাঙ্গীরনগরে তৈরি হয়েছে। অনেকে বলে, এই ঘটনাগুলো কি এখানে বেশি ঘটে? আসলে ঘটনা সব জায়গায় ঘটে। এখানে প্রতিরোধ হয় বলে এখানকার ঘটনা আলোচিত হয়। যথারীতি তখন প্রশাসন-সরকার-সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সেটি মোকাবিলা করতে হয়েছে। তখন কোনো আইন ছিল না যে যৌন নিপীড়নের বিচার কিভাবে করা হবে। শিক্ষকদের অনেকেরও খুব ভুল ধারণা ছিল কিংবা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে তাঁদের মধ্যে মেয়েদের অভিযুক্ত করার প্রবণতা ছিল। আমাদের এ রকম শিক্ষকদের সঙ্গে এক ধরনের মোকাবিলা করতে হয়েছে, লেখালেখির মাধ্যমে জাতীয়ভাবে প্রচারণাগুলোর মোকাবিলা করেছি, প্রশাসনকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আবার কিভাবে ধর্ষণের বিচার হতে পারে সে জন্য তদন্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। আমরা কয়েকজন শিক্ষক এটির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চ করলাম। তখন এসব নামে সংগঠন হতো না। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ—এ শব্দগুলোই কেউ বলত না। তখন নারী বিষয়টি সামনে আনার জন্য সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একটি বই লিখি। ‘নারী পুরুষ ও সমাজ’ নামে পরে সেটি প্রকাশিত হয়। প্রতিটি আন্দোলনের কোনো না কোনো প্রভাব থাকে। আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয় না। সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় আমরা যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা করার চিন্তা করি। আমি, রেহনুমা আহমেদ, নাসিমা আখতার হুসাইনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক বসে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করি। অনেকবার খসড়া করার পর সেটি প্রশাসনের কাছে জমা দিই। একপর্যায়ে প্রশাসন প্রাতিষ্ঠানিক কমিটি গঠন করে। আমি সেই কমিটির সদস্য ছিলাম এবং আমাদের খসড়া নীতিমালাটি কমিটির মাধ্যমে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা’ হিসেবে আইনগতভাবে গৃহীত হয়। ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) একে নীতিমালার কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করে। সেটির ভিত্তিতেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং হাইকোর্ট যে নির্দেশাবলি প্রদান করেছেন তা দেখলেও বোঝা যাবে, তাঁরাও আমাদের নীতিমালাই অনুসরণ করেছেন।  

তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হলেন?
১৯৯৭ সালের জুন মাসে মাগুরছড়ায় (অক্সিডেন্টাল) বিস্ফোরণ হয়। সেই ঘটনার পর আমরা জানতে পারলাম, এ ধরনের তেল-গ্যাস চুক্তিগুলো সরকার করছে সম্পূর্ণ গোপনে, প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টে। ব্যক্তিগতভাবে পুরো ব্যাপারটি বুঝতে আমার একটু সুবিধা ছিল। কারণ সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা নিয়ে পড়ালেখা ও লেখালেখি করার সুবাদে আগে থেকে কিছু ধারণা ছিল। বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে ১৯৮১ সালে বিচিত্রায় সিরিজ করছিলাম। তখন তো মাস্টার্সে পড়ি। সিরিজের একটি বিষয় ছিল ‘জ্বালানি’। সারা পৃথিবীতে জ্বালানি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কী কী করে, এ নিয়ে আমার লেখায় বিশ্লেষণ ছিল। তখন বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব ছিল না। জাতীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা তখন ভালো কাজ করেছিল। সেই অনুসন্ধানটি আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে বাংলাদেশে কী হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে বুঝতে অনেকখানি সাহায্য করল। সেভাবেই আমার ভূমিকাটি আমি নির্ধারণ করি। কারণ এটার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রশ্নসহ অনেক কিছু সম্পর্কিত। ফলে প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে জাতীয় কমিটিতে যুক্ত হই। এ আন্দোলনে একই সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে হয়, রাস্তায়ও যেতে হয়। কারণ বিশেষজ্ঞ নামধারী, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা, বহুজাতিক কম্পানির কর্মচারীরা তো সারাক্ষণ ভুল তথ্য-থিওরি দিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো খণ্ডন করতে হয়। আবার রাস্তায় সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়। এই করতে করতে আমরা গ্যাস রপ্তানি ঠেকাতে পারলাম। তখন যদি গ্যাস রপ্তানি ঠেকানো না যেত, তাহলে দেশের অবস্থা অনেক খারাপ হতো। এই পরিমাণ তেল আমদানি করতে প্রতিবছর ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগত। যে পরিবেশবান্ধব সিএনজি জ্বালানি পাচ্ছি, তারও সম্ভাবনা থাকত না। এরপর টাটা এক ভয়ংকর প্রস্তাব নিয়ে এলো। সেটির বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হলো। তারপর এলো ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান। চারদলীয় জোটের সময় তারা যখন ভয়ংকরভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, স্থানীয় আন্দোলনের সঙ্গে আমরা যুক্ত হলাম। ২৬ আগস্টের বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের সময় চারদলীয় জোট সরকারের বিডিআর তো আমাদের ওপর গুলিই চালাল। তিনজন নিহত হলেন। কিন্তু সরকার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলো। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সেখানে গিয়ে আমাদের সঙ্গে সংহতি জানালেন। তাঁরা সরকারে আসার পর দেখা গেল, এই চক্রান্তই চলতে থাকল। সুতরাং আমাদের প্রতিরোধ অব্যাহত আছে।  

কনোকো-ফিলিপসের আন্দোলন?
এটি আমাদের আরেকটি বড় আন্দোলন। যখন আমরা আন্দোলন করি, সরকার, বহুজাতিক কম্পানি, বিশেষজ্ঞরা বলত, কনোকো-ফিলিপস খুবই দক্ষ; ওরা না এলে আমাদের সর্বনাশ হবে। এরপর দেখা গেল, কনোকো-ফিলিপস আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে সাবকন্ট্রাক দিল। আমরা বলছিলাম, কাজটি জাতীয় সংস্থার হাতে থাকুক; যেখানে ঘাটতি আছে, সেখানে প্রয়োজনে সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া যাবে। কিন্তু জাতীয় মালিকানায় না রেখে কনোকো-ফিলিপসকে দেওয়া হলো। একপর্যায়ে কনোকো-ফিলিপস বলেছে, দাম না বাড়ালে আমরা কাজ করতে পারব না। তারপর বলছে, আমরা চলে যাব। তারা যদি চুক্তিতে না যেত তাহলে এই কয়েক বছর (২০০৯-১৫) নষ্ট হতো না। কিন্তু কমিশন, নানা রকম দুর্নীতিতে এ খাতটি অনেক ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এর কুফল আরো বেশি দেখা যাবে। সামনে দুটি ভয়ংকর প্রকল্প আছে, একটি সুন্দরবন-রামপাল, আরেকটি রূপপুর। দুটিই খুবই বিপজ্জনক; একটি তো পরিষ্কারভাবে সুন্দরবনকে শেষ করে দেবে। সুন্দরবনের কোনো বিকল্প হয় না। আমি মনে করি, সুন্দরবন রক্ষা সবার জাতীয় দায়িত্ব। রূপপুরে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে। এটির ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, লোন নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যেসব ন্যূনতম শর্ত, যেমন—পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কী হবে, আশপাশের কয়েক কোটি মানুষের নিরাপত্তার কী হবে—এসব বিষয় নিয়ে এখনো কিছু হয়নি। এটা তো সবার স্বার্থ। এতে যত বেশি সর্বজন যুক্ত হবে, তত বেশি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।  

আন্দোলন তো সরকার, বহুজাতিক কম্পানির বিরুদ্ধে। ঝুঁকি কেমন?
আগে থেকেই ঝুঁকির মধ্যে আছি, সব সময় নিরাপত্তাহীনতার বোধ আছে। যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকে আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশে সব মানুষই এখন নিরাপত্তাহীন। আলাদা করে নিরাপত্তাহীনতার বোধ নিয়ে লাভ নেই। নিরাপত্তাহীনতা থেকে বেরোনোর সবচেয়ে বড় রাস্তা হলো, আরো বেশি বেশি এ বিষয়গুলো নিয়ে বলতে হবে, বেশি সরব থাকতে হবে, মানুষকে আরো বেশি যুক্ত করতে হবে। এটিই একমাত্র নিরাপত্তা দিতে পারে। এই বাইরে আর কোনো উপায় নেই।  

ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ, তাদের সব কাজে আপনারা বাধা দেন।
বাধা তো দিতেই চাই। আরো শক্তিশালীভাবে বাধা দিতে চাই। যে কাজে মানুষের সর্বনাশ হবে, দেশ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যে কাজের সঙ্গে দুর্নীতি-লুণ্ঠন-সম্পদপাচার জড়িত, সেসব কাজের যে মাত্রায় বিরোধিতা করা দরকার, তা তো করতে পারছি না। শক্তি আরো কিভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করছি। টক শোতে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনারা সব কাজে বাধা দেন। গ্যাস রপ্তানি, টাটা, ফুলবাড়ী, রামপাল, টিফা, টিপাইমুখ ইত্যাদি বলা হলো। বললাম, এত না বলে আপনি সব একসঙ্গে বলতে পারেন, ‘কেন আপনারা সব সময় অনিয়ম-দুর্নীতি-লুণ্ঠনের বিরোধিতা করেন?’ তাহলে এত কিছু বলতে হবে না। যেগুলোর কথা বললেন, সব কটির মধ্যেই তো দেশের স্বার্থবিরোধী উপাদান আছে, অনিয়ম-দুর্নীতি-লুণ্ঠন আছে। সরকার তো আরো কত কাজ করছে; তাতে তো আমরা কিছুই বলছি না। প্রশংসা পাওয়ার কাজ করলে অবশ্যই প্রশংসা করি।