গত ৩১ মের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন৷ তাঁর বক্তব্যে অগ্রাধিকার পায় জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা না-করা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদদের দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির বিষয়৷ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধির প্রতিক্রিয়া এখানে প্রকাশ করা হলো:
সরকারের ভুলভ্রান্তি, অপরাধ, দুর্নীতি, অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ উঠলে বরাবরই তা অস্বীকার করার সংস্কৃতি সরকারের মধ্যে প্রবল। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেও এই অস্বীকারের সংস্কৃতিই প্রধান হয়ে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা স্মারক হিসেবে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন যে এতে কতটা সোনা আছে তা গুরুত্বপূর্ণ না, সম্মাননাই আসল। ঠিকই যে এই সম্মাননা মাটির জিনিস দিয়েও দেওয়া যেত।
কিন্তু স্বর্ণপদক বলে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারপর সেখান থেকে ১২ আনা বা ১৬ আনা সোনা সরিয়ে অন্য কিছু দেওয়া চৌর্যবৃত্তি ছাড়া আর কী হতে পারে? এটা শুধু জাতি হিসেবেই আমাদের ছোট করেনি, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকেও তা কলঙ্কিত করেছে। এই জালিয়াতি যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দায়ী ব্যক্তিদের শঙ্কিত করার বদলে স্বস্তি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, র্যাব বিএনপির আমলে সৃষ্টি হয়েছে। তাই এর দায় বিএনপিরও। কিন্তু র্যাবের ভূমিকা ক্রমান্বয়ে আরও আগ্রাসী হয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সরকারের প্রভাববলয়ে থেকে দখলদার লুটেরাদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এই সংস্থাগুলো নদী-জমি দখল, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস রোধ না করে বরং এসব যাঁরা করছে, তাঁদের রক্ষক হিসেবে কাজ করছে। এখন টাকার বিনিময়ে খুনের অভিযোগ এসেছে। বিএনপি আমলে র্যাব গঠিত হয়েছিল বলে তার এখনকার অপরাধ যৌক্তিক হয়ে যায় না।
জাপানের কাছ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া যাবে বলে প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে ঋণ পাওয়া মানেই উন্নয়ন নয়, বরং তা অনেক সময় ধ্বংস ও নৈরাজ্যের কারণ হয়। যেমন ঋণ নিয়ে সুন্দরবন ধ্বংসের চেষ্টা চলছে, ঋণের প্রকল্পে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, নদী খুন হচ্ছে, রেলওয়ে আটকে গেল, পাটশিল্প বিনাশ হলো, জাতীয় সম্পদ হাতছাড়া হচ্ছে। ঋণ কেন, কী শর্তে, কোন কাজে, কাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হবে—সেসবের ওপর এর ফলাফল নির্ভর করে।
আগামী পাঁচ-ছয় বছরে জাপানের ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া যাবে বলে মাতামাতি হচ্ছে, অথচ আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রতিবছরই দেশে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছেন! তাঁদের জীবন আর সেই বিশাল প্রাপ্তির উৎপাদনশীল ব্যবহার নিয়ে পরিকল্পনা বা উৎসাহ নেই।
‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার’ নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ও তাঁর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন থেকে মনে হচ্ছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো আইনি বিষয় নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আমাদের দেশে আইন নিজের গতিতে চলে না, চলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতার বলে।
১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ যোগ দিলেও পরবর্তীকালে তারা সেখান থেকে পিছিয়ে আসে, জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতও করে। এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার–প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই অঙ্গীকার নিয়েই ২০০৮ সালে তারা ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এই বিচার–প্রক্রিয়ায় শ্লথগতি এবং উল্টো কথায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ফরমালিন দিয়ে বিএনপিকে তাজা রাখার চেষ্টা করছে— প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। তবে আমার ব্যাখ্যাটা একটু ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা, সন্ত্রাস, দখল, দুর্নীতির বিস্তার না ঘটলে বিএনপির অস্তিত্ব আরও সংকুচিত হতো।
আওয়ামী লীগের বর্তমান ভূমিকাই বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর বিএনপি-জামায়াতের রেকর্ড ও সে সম্পর্কে ভীতি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ধরে রেখেছে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুজন দুজনকে রক্ষা করছে, দুজনই দুজনের ফরমালিন।
জনগণের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-দখলদারদের দাপটের মুখে তাঁরা শেষ ভরসা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথায় জনগণ কোনো ভরসা পায় না। ভরসা পায় এই সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-দখলদারেরাই।
(জুন ০২, ২০১৪ তাইখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)